.দীর্ঘদিন ধরে জান্তা সরকারের সীমাহীন নিপীড়ন এবং জাতিগত বর্বরতার শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশিরা কেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় শামিল হলো? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র।
‘অভাব, কাজ নাই, সংসার চলে না’—বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার সেলিম উদ্দিন। একই গ্রামের রফিকসহ তিনি ভাগ্য বদলের জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে দালালদের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। এখন ঠাঁই হয়েছে সংখলা প্রদেশের রাত্তফোম জেলার বন্দিশালায়। ৯ মে থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে আরও অনেকের সঙ্গে এঁদের উদ্ধার করে সেখানকার পুলিশ।
এ প্রতিবেদক গত এক সপ্তাহে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দিশালায় থাকা অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন। ফোনে কথা হয়েছে থাই জঙ্গল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফেরা কয়েকজনের সঙ্গেও। বেশির ভাগ মানুষেরই দাবি, তাঁরা ঘর ছেড়েছেন অভাব আর বেকারত্ব ঘোচাতে। কেউ কেউ ভালো উপার্জনের প্রলোভনে পড়ে বা প্রতারণার শিকার হয়েও পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছেন।
আর এর সুযোগ নিয়েছে মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া—এই চার দেশের চক্র মিলে গড়ে উঠেছে মুক্তিপণ-বাণিজ্য।
তবে সবার সমুদ্রযাত্রার কাহিনি এক নয়। তিন ধরনের ঘটনা শোনা গেছে থাই বন্দিশালায় আটক ভুক্তভোগীদের মুখে। এক. কেউ এসেছেন স্বেচ্ছায় দালাল ধরে আগাম টাকা দিয়ে। তারপর তাঁদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে, নির্যাতন করে দেশে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। দুই. আগাম কোনো টাকা লাগবে না বলে দালাল চক্র মিথ্যা আশ্বাস ও প্রলোভনে ফেলে অনেককে নিয়ে আসে। তিন. জোর করে ও জাহাজে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নৌকায় তুলে দেওয়ার ঘটনাও আছে। তবে এটা বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে কম।
সিরাজগঞ্জের রায়হান বেকারত্ব ঘোচাতে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নিজেই দালাল ধরেন। জমি বিক্রি করে দালালকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ‘আমরা জানি বিদেশি জাহাজে যাব। সেখানে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো রুম। গদির বিছানা। আর মালয়েশিয়া গেলেই চাকরি। কিন্তু এসে দেখি তিনতলা কাঠের বড় নৌকা। কিছু বলার উপায় নেই। শুরু হলো সমুদ্রের বুকে বন্দিজীবন, এরপর থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। আবার বন্দী, খাবার নাই, পানি নাই, গোসল নাই, টাকার জন্য মারধর…বলে শেষ করা যাবে না।’ বলছিলেন এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করা রায়হান।
এ বিষয়ে পত্রিকায় এত লেখালেখি, টেলিভিশনে প্রচার, কখনো দেখেননি? রায়হানের জবাব, ‘এটা দালালদের জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলল, সাংবাদিকেরা বানাইয়া বানাইয়া লেখে।’
জঙ্গল থেকে অনেকের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া রায়হান এখন থাইল্যান্ডের বন্দিশালায়। তাঁর মতোই গণমাধ্যমের খবরকে বিশ্বাস করেনি চুয়াডাঙ্গার রফিকও। রফিকদের সমুদ্রযাত্রার গল্প ভিন্ন। তাঁদের দালাল বলেছে, আগাম কোনো টাকা লাগবে না। মালয়েশিয়া পৌঁছে টাকা দিলে হবে।
কিংবা রোজগার করে কিস্তিতেও দিতে পারবে। রফিকের মতো সম্প্রতি যাঁরা থাইল্যান্ডে পাচারকারীদের ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এ প্রলোভন বা প্রতারণার ফাঁদে পড়া বলে জানা গেছে।
মুক্তিপণ দিয়ে সম্প্রতি দেশে ফেরা নূর নবী জানালেন, তাঁকে জোর করে তুলে নিয়েছে দালালেরা। সেটা কীভাবে সম্ভব? নুর নবী বলেন, তাঁরা তিন বন্ধু কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। অপর দুজন হলেন ফেনীর রফিক ও চট্টগ্রামের মিঠু। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে টানা হরতাল-অবরোধের কারণে কক্সবাজার ছিল পর্যটকশূন্য। আয়-রোজগার ছিল না। তখন ডিসেম্বর মাস। টেকনাফের এক দালাল প্রস্তাব দেয়, মালয়েশিয়ায় অনেক কাজের সুযোগ আছে। কোনো টাকা লাগবে না। মালয়েশিয়া গিয়ে মাসে মাসে বেতন পেয়ে কিস্তিতে টাকা শোধ করলে চলবে। কিস্তির টাকা দিয়েও বাড়িতে ৫-১০ হাজার টাকা করে পাঠানো যাবে।
নূর নবীর দাবি, এতে তিনি রাজি হননি। রফিক ও মিঠু রাজি হন। দুই বন্ধুকে বিদায় জানাতে তিনি টেকনাফ পর্যন্ত যান। তখন তাঁকেও জোর করে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘এত চিৎকার করলাম, কেউ এগিয়ে এল না। বড় ট্রলারে তুলে আমাদের আটকে রাখে। সেখানে আরও অনেক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি ছিল। তিন দিন পর ট্রলার ছাড়ে। আট দিন, আট রাত পর ট্রলারটি থাইল্যান্ডে পৌঁছায়। এরপর পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে তাঁদের নেওয়া হয় মালয়েশিয়ার সীমানায় বাদাম বেসার জঙ্গলে।
নূর নবী জানান, তত দিনে ক্ষুধা, পিপাসায় তাঁরা সবাই ক্লান্ত, তার ওপর মারধর। এরপর দালালেরা থাই ফোন দিয়ে দেশে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় নূর নবীকে। মুক্তিপণ চায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ভাই গ্রামে জমি বেচে দালালদের টাকা পাঠান। এরপর নির্যাতন থামলেও মুক্তি মেলেনি। একদিন পুলিশ এসে ক্যাম্প থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর জেল খেটে দেশে ফেরা। সেটা আরেক বেদনাদায়ক পর্ব।
কিন্তু নূর নবী তবু প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন। অনেকের মৃত্যু হয়েছে সাগরে, জঙ্গলে-নির্যাতন, অনাহার কিংবা অসুস্থ হয়ে। অনেকে নিখোঁজ। ১ মে এমন ৩২টি লাশের কঙ্কাল উদ্ধার এবং কয়েকটি গণকবরের সন্ধান মেলার পর থাই সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে সাগরপথে পাচারের শিকার মানুষদের ওপর বর্বরতার ঘটনাগুলো বিশ্বব্যাপী আলোচিত খবর।
দক্ষিণ থাইল্যান্ডের এসব এলাকায় একাধিক সরকারি কর্মকর্তা এবং পাচারকারী চক্রগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাগর পথ চালুর পর থেকেই সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশিরা আসছিল। যদিও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছিল সাগরপথের মূল যাত্রী। ২০০৯ সাল থেকে সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশির সংখ্যা বেশ বাড়তে থাকে।
সংখলা প্রদেশে কোনো বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা আটক হলে দোভাষী হিসেবে ডাক পড়ে আরাকান বংশোদ্ভূত থাই নাগরিক আমিন সাইয়্যাকের। গত এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যাঁরা আইস্যে না, এঁরার ৭০ ভাগই বাংলাদেশের বাচ্চা ছেলে।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কিছু নেই। টাকা দিতে পারে না। মাসকে মাস জঙ্গলে আটকা থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশিদের কাছ থেকে দ্রুত মুক্তিপণ পাওয়া যায়। এ কারণে বাংলাদেশিদের প্রতি পাচারকারী চক্রের আগ্রহ বেশি।
২০০৯ সাল থেকে সাগরপথে মানব পাচার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে আসছেন দক্ষিণ থাইল্যান্ডের স্থানীয় এক সাংবাদিক। তাঁর অনুমান, থাই উপকূল দিয়ে গত এক বছরে যত মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে, তাদের অর্ধেক বাংলাদেশি। সম্প্রতি যারা এ দেশে আটক বা উদ্ধার হয়েছে, তাদের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি।
গত ২০ দিনে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের পরিসংখ্যানও ওই সাংবাদিকের আন্দাজকে সমর্থন করে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আন্দামান সাগরে আটকে পড়া অবৈধ অভিবাসীদের অর্ধেকই বাংলাদেশি। তারা অর্থনৈতিক কারণেই দেশান্তরি হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৫ হাজার মানুষ সাগরপথে দেশ ছেড়েছেন। এদের অন্তত ৩০০ জন মারা গেছে।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার কথা হয় কেরাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুণ অর রশিদের সঙ্গে। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে মালয়েশিয়ায় কাজ করেন তিনি। অভিবাসী-সংক্রান্ত জাতিসংঘের এক সভায় যোগ দিতে এখন তিনি থাইল্যান্ডে। তাঁর দাবি, মালয়েশিয়ার এমন কোনো কর্নার পাবেন না, যেখানে সাগরপথে আসা বাংলাদেশি নেই।
হারুণ অর রশিদ বলেন, মুক্তিপণ দিয়ে যেসব বাংলাদেশি মালয়েশিয়া পৌঁছাতে সক্ষম হন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাঁদের একটা অংশের ঠাঁই হয় এ দেশের কারাগারে, অন্যদের বেশির ভাগেরই কর্মস্থল হয় রাবার বাগান বা পাম অয়েল প্ল্যান্টেশনে। কেউ কেউ রেস্তোরাঁয় বা কারখানায় কাজ পান। কিন্তু সারাক্ষণ থাকেন পুলিশ-আতঙ্কে। কঠোর পরিশ্রম করেও কম বেতন পান।
সংখলার আমিন সাইয়্যাক জানালেন, তিনি এখানকার বন্দিশালায় পুলিশের দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে আগে কক্সবাজার বা চট্টগ্রামের মানুষ পেতেন। গত এক বছর অনেক জেলার মানুষকে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তঁরার দেশিত মানুষ জঙ্গলে ও আশপাশে মরে পড়ে থাকতেও দেখেছি। রোহিঙ্গা মইরছে মনে করে তঁরার সরকার খবরও নিতো না।’
অনেক দিন ধরে দেশে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে বাংলাদেশি নামে যারা সাগরপথে যাচ্ছে, তাদের বড় অংশ এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। কিন্তু এ প্রতিবেদক দক্ষিণ থাইল্যান্ডের পাঁচটি বন্দিশালা ঘুরে সমুদ্রপথে এসে আটক হওয়া বাংলাদেশের ১৫ জেলার মানুষের হদিস পেয়েছেন। জেলাগুলো হলো কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও কুষ্টিয়া।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে তো মিয়ানমারের মতো জাতিগত সহিংসতা নেই। সামরিক সরকারও নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার কমনওয়েলথভুক্ত ৩৭ সাংসদের একটি প্রতিনিধিদলকে বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে। গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা হবে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। তার পরও বাংলাদেশিরা কেন রোহিঙ্গাদের কাতারে শামিল হচ্ছেন?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের পাচার হওয়া এবং বাংলাদেশিদের পাচার হওয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। রোহিঙ্গারা কোনো দেশের নাগরিক না। তারা চরম কোণঠাসা হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার প্রায়ই বলে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে দেশের নাগরিকেরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে, তা ওই দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করেন, সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খারাপ হতে বাধ্য।