গাজীপুর: একটি গান বিশেষ করে তৃনমূল মানুষের মুখে বেশী শুনা যায়। কারণ এই গানের বাস্তবতা তাদের জীবনে নিত্যদিনের সঙ্গী হওয়ায় মনে মনে বা গুন গুণ করে অথবা দোকানে উচ্চ স্বরে অডিও ভিডিওতে চলে এই গান। গানের তালে তালে হাত তালি দিয়েও গান উপভোগ করতে দেখা যায়। এই গানে মশগুল কোন দোকানে কেউ চা চাইলেও পাইতেও কষ্ট হয়। কারণ গানের সাথে চায়ের আবেদন বার বার ফেল করে যায়।
আমায় ডুবাইলিরে আমায় ভাসাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে।
কুল নাই সীমা নাই অথই দরীয়ায় পানি
দিবসে নীশিথে ডাকে দিয়া হাত ছানিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে।
আমায় ডুবাইলিরে আমায় ভাসাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে।
স্ত্রী ঘরণী আর স্বামী চা বিক্রেতা। যা আয় করত তা দিয়েই চলত সংসার। কিন্তু বিশ্ব মহামারী করোনায় সব শেষ করে দিয়েছে। দুই বছর দেনা করে খেয়ে পড়ে জীবন যাপন করার পর এখন দেনার ভারী বোঝা মাথায়। মাসিক কিস্তি ৫০ হাজার টাকা। বিভিন্ন সমিতি থেকে নেয়া ঋনের কিস্তি দিতে হয় দৈনিক সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে। স্বামী চা বিক্রি করে কিস্তির সব টাকা দিতে না পারায় মাঠে নামেন স্ত্রী। স্ত্রী চায়ের দোকান করেন আর স্বামী মজুরী কাজ করেন। দুটি কাজ দিয়ে কোন মতে কিস্তি দেয়া যায়, দিয়ে না দিয়ে। সময়মত কিস্তি দিতে না পারলে রাস্তা-ঘাটে স্বামী-স্ত্রীকে মাথানীচু করে অপমান সইতে হচ্ছে নিয়মিত। তবুও জীবন চালাতে হবে তাই চলছে। জীবন সংগ্রামের। যতক্ষন বেঁচে থাকা হবে ততক্ষন সংগ্রাম করতে হবে।
রুবি জানালেন, বাবার সংসারে অভাবের ভার নিতে ৫ম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় তিনি পোষাক কারখানায় চাকুরীতে যান । চাকুরী করাকালীন ৩বছর পর ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় চা বিক্রেতা উজ্জ্বলের সাথে। বর্তমানে ২৪ বছরের রুবির দুই সন্তান সহ ৪ সদস্যের পরিবার গাজীপুর শহরের মধ্যপাড়ায় বসবাস করেন। স্ত্রী চা বিক্রি করেন আর স্বামী দৈনিক মজুরীতে কাজ করেন। উভয়ে আয় চলে যায় বিভিন্ন সমিতির ক্যাশে। রাত-দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর সন্তানের চাহিদা যেন সমিতির কিস্তির কাছে তুচ্ছ। টাকা থাকুক বা না থাকুক কিস্তি দিতেই হবে। যে কোন মূল্যে। এই পরিস্থিতি দুই বছর চলা করোনার পর থেকে।
রুবি শুনছেন, দুর্ভিক্ষ আসছে। এই দুঃসংবাদ শুনে রুবি দম্পতির আশংকা এবার মরেই যেতে হবে। দুর্ভিক্ষ হলে আর বাাঁচার উপায় নেই। দেনার ভারে ন্যুব্জ রুবির সংসার যদি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয় তবে বেঁচে থাকা আর হবে না জানালেন সংগ্রামী এই নারী।
করোনায় সরকারী বেসরকারী কোন সাহায্য বা বাংক ঋন কোন কিছুই পায়নি রুবি আক্তার। সাহায্য ও সহযোগিতা তার কাছে সোনার হরিণ। এসবের নাম শুনেছেন তবে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। করোনার থাবায় অচল রুবির সংসার ডুবে আর ভাসে।
উজ্জ্বল ও রুবি জানালেন, মাসে একাবারও গরুর মাংস তাদের কপালে জোটেনা। পোলাও মাংস তো দূরের কথা। বাচ্চাদের আবদার চোখের জল ছাড়া মেটানো সম্ভব নয়। একটি বাচ্চা স্কুলে স্কুলে যায় এই চা দম্পতির। সেই বাচ্চা যখন বিভিন্ন বায়না ধরে তখন মায়ের চোখের জল ছাড়া আর কিছুই দেয়া যায় না।
হায়রে দুনিয়া। সবাই মানুষ। কারো বাচ্চা কেন দুধ খায়না, সেই চিকিৎসা করতে ডাক্তার দেখাতে হয় আবার কারো বাচ্চা যখন ভাত পায় না তখন তাকে না খেয়ে মায়ের চোখের জলে ভিজে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। অদ্ভুত দুনিয়ার ভয়ঙ্কর রুপ। দুনিয়া নামক খেলার মাঠে কে ভালো আছেন আর কে মন্দ আছেন তা বুঝাও এখন মুশকিল। কারণ কেউ কারো খবর রাখে না।