বিদ্যুৎ গ্রিডে বিপর্যয় এবং গ্যাস ও জ্বালানি তেলের অভাবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। গ্রাহকদের আগেই জানিয়ে সরকার এলাকাভিত্তিক দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের যে সূচি দিয়েছিল, সেটা ওলটপালট হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় এখন অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। দিনে-রাতে যখন-তখন লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের বেলা কয়েক দফা লোডশেডিং হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। লোডশেডিং থেকে নিস্তার পেতে শীতের অপেক্ষায় আছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আগামী মাস থেকে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারকরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সার্বিক অবস্থা মিলে বিদ্যুৎ খাতে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে দ্রæত লোডশেডিং থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই সমাধান, সেটা হলো যত দামই হোক, বিদেশ থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে সরবরাহ বাড়ানো। একই সঙ্গে তরল জ্বালানির তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বাড়ানো। তবে দুটোর একটাও আপাতত সরকার করছে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অর্থ সংকটে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও উচ্চমূল্যে এনএনজি আমদানিতে অর্থ ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের কাছে গত কয়েক মাসে বিল বাবদ পিডিবির কয়েক হাজার কোটি টাকা দেনা হয়েছে। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরাও তেল আমদানি করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাচ্ছেন না, যার কারণে বিদ্যুৎ সংকট রয়েই
যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফলে আপাতত বিদ্যুৎ বিভাগ শীতের অপেক্ষা করছে। কারণ শীত নেমে এলে বিদ্যুৎতে চাহিদা কমে আসবে। ফলে কম বিদ্যুৎকেন্দ্র চালালেও চাহিদা পূরণ করা যাবে।
এদিকে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে গতকাল কথা হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিদেশ থেকে এলএনজি আনতে না পারায় আগামী নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি বলেন, লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি, সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এ জন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। আমরা চেয়েছিলাম, অক্টোবর থেকে কোনো লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি আবার অন্য রকম করে ফেলে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই মাসটা (অক্টোবর) একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন ইন্ডাস্ট্রিতে গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবরে কোনো লোডশেডিং হবে না, ভালো পরিস্থিতি হয়ে যাবে। কিন্তু এখন দেখলাম সেটা হলো না। কারণ, ইন্ডাস্ট্রিতে ডিমান্ড বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস কমিয়ে দিয়েছি। আর কমিয়ে দেওয়ার কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এ সময় শিল্পকারখানায় উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে গতকাল পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দিনের বেলা বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার মেগাওয়াট, উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট। সন্ধ্যায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট। পিডিবির তথ্য বলছে, ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অধিকাংশই নানা কারণে বন্ধ রয়েছে। কিছু কেন্দ্রে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চলছে। বাকি কেন্দ্রগুলো গ্যাস ও জ¦ালানি তেলের অভাবে বন্ধ অথবা কম উৎপাদন করছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্ধেকই বন্ধ। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই সক্ষমতার কম উৎপাদন করছে। মূলত বিদ্যুৎ কম উৎপাদনই লোডশেডিং বৃদ্ধির কারণ। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো মোট উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক। অথচ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্ধেকের বেশি বন্ধ।
এদিকে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘোড়াশালের একটি সাবস্টেশনে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। আমরা সেটা দ্রæততার সঙ্গে ঠিক করার চেষ্টা করছি। ঠিকাদার পরিবর্তন করে কাজ করাচ্ছি, যাতে আজ-কালের মধ্যে সারিয়ে তুলতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি আজকের (গতকাল সোমবার) মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।’
তীব্র লোডশেডিং কেন হচ্ছে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিডের মাধ্যমে আগে রাজধানীতে ১১শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হতো। গ্রিড বিপর্যয়ের পরে তা কমে ২৪০ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন কিছুটা বাড়বে। আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, তার কাছাকাছি চলে যেতে পারব।
এত সংকট তীব্র হলো কেন এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিল পরিশোধে কিছুটা সংকট তৈরি হওয়ায় তারা ডিজেল, ফার্নেস তেল আমদানি করতে পারছে না। তাদের মে মাসের ৩০ শতাংশ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সচিব বলেন, বিদ্যুৎ সংকট মূলত বেড়েছে গ্যাস সংকটের কারণে।
তিনি বলেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হলো পিকিং পাওয়ার প্লান্ট। শুধু পিক টাইমে চালানোর জন্য এগুলো এখনো রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা হলো প্রায় ১১ হাজার ২শ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ৫ হাজারের মতো চালানো যাচ্ছে। ছয় হাজার চালানো গেলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত।
এদিকে জ¦ালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের দুই সচিব, পেট্রোবাংলা এবং পিডিবির চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘মূলত বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নতি করার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে ভোলার গ্যাস কিভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
এদিকে গতকাল বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলার) ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, দেশের গ্যাসভিত্তিক ৭১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা এক হাজার ৯১৪ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৯৯১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্ধাৎ চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও সরবরাহ করা যায়নি। প্রসঙ্গত দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার গতকালের তথ্য বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য খাতে গতকাল সর্বোচ্চ গ্যাসের সরবরাহ করা হয়েছে দুই হাজার ৬১৪ মিলিয়ন ঘনফুট। যার মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ৩৮০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় অন্তত দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি বিদ্যমান। গতকালে হিসাবে দেখা যায়, গ্যাসভিত্তিক প্রায় ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।