ঢাকার বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী পি কে হালদারের মতো বগুড়ার ব্যবসায়ী সমীর প্রসাদ দত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সপরিবারে উধাও হয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র মতে তিনি ভারতের শিলিগুড়ি ও কলকাতায় ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। মাঝে মধ্যে তিনি ভারত থেকে বগুড়ায় এসে আত্মগোপনে থাকেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে শুধু সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ একশত কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু বন্ধকী সম্পত্তির দাম যৎসামান্য। এতে বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল টাকা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বগুড়ার আদালতে দায়েরকৃত মামলা সূত্রে জানা গেছে, সমীর প্রসাদ দত্ত বগুড়া শহরের ঝাউতলা রাজাবাজারের মৃত শ্যামা প্রসাদ দত্তের ছেলে। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তারা চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই এখন ভারতে তার ব্যবসার সাথে জড়িত। সমীর দত্ত ছাড়াও অপর তিন ভাই হলেন, অনুপ কুমার দত্ত, সুনীল কুমার দত্ত ও নির্মল কুমার দত্ত। নির্মল কুমার দত্ত বগুড়ায় বসবাস করেন। সমীর প্রসাদ দত্ত আমদানি-রফতানিসহ বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ব্যবসা বাণিজ্যের একপর্যায়ে ২০২০ সালের দিকে বগুড়া থেকে দুই ভাই ও পরিবার নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েক শত কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর তার ঋণ আদায়ে বিভিন্ন ব্যাংক মামলা করলেও তিনি কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। তাই আদালত বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করে দেনা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, সমীর প্রসাদ দত্ত কাহালুর নৈহটি মৌজার ১ তফসিলে ২ দাগে ২৯ শতক, ভাগদুবড়া মৌজার ২ তফসিলে ৫ দাগে ১৩৩ শতক ও বিন্চপুর মৌজার ১ দাগে ৭২ শতকসহ মোট ২৩৪ শতক ধানী জমি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখায় বন্ধক রেখে তার দত্ত এন্টারপ্রাইজ ও আরেক ভাই অনুপ কুমার দত্তের মালিকানাধীন ঝাউতলার স্টাইল গিফট শপের নামে গত ১০ বছর আগে আট কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। কিন্তু সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক ২০১৭ সালে বগুড়া অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করে। বর্তমানে সুদসহ দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ১৭ হাজার ৩২ টাকা। তাই আদালত পাওনা আদায়ে বন্ধকী ২৩৪ শতক জমি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে।
বর্তমানে ওই জমির সরকারি মূল্য প্রায় ৭৯ লাখ ৯৫ টাকা। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সম্পদের দামের অর্ধেক লোন পায় গ্রাহক। সে হিসাবে তিনি ঋণ পাওয়ার কথা ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু ৭৯ লাখ টাকার জমির বিপরীতে ঋণ দেয়া হয় ৮ কোটি টাকা। ঋণ দেয়ার আগে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে ম্যানেজ করে বিপুল টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে বলে ব্যাংকারদের অভিমত। বন্ধক রাখা জমি সরকারি দামে বিক্রি হলে ৭৯ লাখ টাকা আদায় হতে পারে। বাকি প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যাংকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বগুড়া অর্থ ঋণ আদালতের সর্বশেষ তথ্য মতে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিলামে দরপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ওই জমি দেড় কোটি টাকায় কিনতে দরপত্র জমা দিয়েছেন। আদালতের বিচারক ছুটিতে থাকায় আগামী ১০ অক্টোবর ২০২২ নিলামের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানা গেছে। এ দিকে ব্যবসায়ী সমীর প্রসাদ দত্ত তার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার অলোক কুমারকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করে গত তিন মাস আগে বগুড়ার একজন ব্যবসায়ীর কাছে বন্ধকী ওই ২৩৪ শতক জমি বিক্রি করেছেন। ক্রেতাই আবার সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগসাজশে আদালতের কাছ থেকে কম মূল্যে কিনতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তাই ওই নিলামে ওই ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কেউ অংশ নেননি।
এ ব্যাপারে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখার ম্যানেজার ও ব্যাংকের সিনিয়র ফার্স্ট অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো: আবু বকর সিদ্দিক জানান, নিলামের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আদালত জানায়নি। এ ছাড়া সমীর কুমার দত্ত ও তার সহযোগীরা সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখা থেকে ২০১৪ ও ২০১৭ সালে ৬০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের বিপরীতে বগুড়া শহরের বড়গোলা এলাকার (ধড়েরবাড়ী) ২১ শতক ও বগুড়া পৌর এলাকার ১৩ নং ওয়ার্ডের গণ্ডগ্রাম এলাকায় গুদামঘরসহ ২১৩ শতক জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখেন। গণ্ডগ্রামের ওই সম্পত্তির ওপর বর্তমানে সরকারি সংস্থা টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। সেখানে গুদাম ঘর ও খালি জায়গা রয়েছে। প্রতি মাসে সেখান থেকে সমীর দত্তের প্রতিনিধি ভাড়া বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা চেকে গ্রহণ করেন। অপর দিকে ২১ শতক খালি জায়গায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা গ্যারেজ রয়েছে। সেখানকার ভাড়া গ্রহণ করেন সমীর দত্তের প্রতিনিধি। বগুড়া অর্থ ঋণ আদালত সুদসহ ৬৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে শহরের বড়গোলা এলাকার (ধড়েরবাড়ী) ২১ শতক ও গণ্ডগ্রামের ২১৩ শতক জমি বিক্রির জন্য দুই দফা নিলাম করলেও তাতে উপযুক্ত গ্রাহক না পাওয়ায় আদালত আইন অনুযায়ী সোস্যাল ব্যাংকের কাছে মালিকানা হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখা বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান ও ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট কুদরত ই খুদা জানান, আশা করছি আদালত শিগগিরই ব্যাংকের কাছে মালিকানা হস্তান্তর করবে। এরপর ব্যাংক এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ছাড়া সমীর দত্তের সাথে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের সুসম্পর্কের কারণে অসৎ কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজসে তুলনামূলক কম দামি সম্পত্তি বন্ধক রেখে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। আর এই সব ঋণের টাকা ধীরে ধীরে ভারতে পাচার করে সেখানে ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন। ব্যাংকে বন্ধক ছাড়া তার অন্য যেসব সম্পত্তি রয়েছে সেগুলো দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও লেনদেন করেন। এ ছাড়া তিনি নিজেও গোপনে মাঝে মধ্যে ভারত থেকে এসে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে নির্বিঘ্নে ভারতে ফিরে যান। সমীরের ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে বগুড়ার আরো কয়েক ব্যবসায়ী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ভারতে পাচার করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।