স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন রংপুর সিটি করপোরেশনের একটি প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থ অর্থবছরের নির্দ্দিষ্ট সময়ে খরচ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। নিয়মানুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ খরচ করতে না পারলে অর্থবছর শেষ হওয়া মাসে অব্যয়িত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু তা না করে সরকারি টাকা নিজেদের ব্যাংক হিসাবে রেখে দিয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন।
‘রংপুর সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন ও অবকাঠামো উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ নামক প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। খরচ না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হলে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থবছর শেষে সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত না দেওয়ায় গত ১০ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে আইএমইডি। আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২১০ কোটি টাকা। সরকার প্রকল্পটির অনুকূলে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী সব টাকা ছাড় করে। অর্থবছর শেষে কর্তৃপক্ষ সবমিলিয়ে ১৮০ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে। অর্থবছর শেষে বাকি ৩০ কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এই ৩০ কোটি টাকা এখন পর্যন্ত হস্তান্তর না করে প্রকল্পের হিসাবে জমা রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে আইএমইডি।
আইএমইডি জানায়, বর্তমানে প্রকল্পটি আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেক্ষেত্রে মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রকল্পের কাজ কীভাবে শেষ করা হবে অথবা কীভাবে অর্থায়ন করা হবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।
আইএমইডি কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের টাকা হস্তান্তর না করা এবং এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যেহেতু গত অর্থবছরের ৩০ কোটি টাকা এখনও প্রকল্পের হিসাবে রাখা হয়েছে, সেহেতু সিটি করপোরেশন বা কর্তৃপক্ষের এই টাকা আর ফেরত দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা নেই। কারণ এই ৩০ কোটি টাকা যদি প্রকল্প হিসাবে থাকে, তাহলে বছর শেষে বিশাল একটা মুনাফার ভাগ পাবে সিটি করপোরেশন ও কর্তৃপক্ষ। এই ভাবনা থেকেই হয়তো তারা টাকাটা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি।
আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে সিটি করপোরেশন প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও চলতি অর্থবছরে অর্থ চাওয়া হয়নি। কারণ প্রকল্পের অব্যয়িত সব অর্থ বর্তমানে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ যদি বাড়ে তাহলে সিটি করপোরেশন কাজ শেষে আগামী জুনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল কোথা থেকে দেবে? এটা থেকেই বলা যায়, প্রকল্প কর্তৃপক্ষের হিসাবে রাখা অর্থ থেকেই বছর শেষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়া হবে। তবে বিল দেওয়ার আগে বছরব্যাপী ব্যাংকে রাখা ৩০ কোটি টাকার বিশাল মুনাফা হাতিয়ে নেবে রংপুর সিটি করপোরেশন!
প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি এবং সরেজমিন পরিদর্শনে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৪টি ওয়ার্ক প্যাকেজের মধ্যে ১১টির শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ২৩টির কাজ চলমান রয়েছে। যার ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৯০ শতাংশের মতো। ২৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত না হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বড় ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার লক্ষ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট স্কিম একসঙ্গে করে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। টেন্ডার ডকুমেন্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, মো. খায়রুল কবির রানা নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একাই ১০টি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে এবং কেকেধার-আরবিএস জেভি নামক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৪টি প্যাকেজের কাজ। একেকটি প্যাকেজের আওতায় ৭ থেকে ১০টি করে স্কিম থাকায় একক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাব ছিল। যার ফলে প্রকল্পটি যথাসময়ে সমাপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়ছে। প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্যে দেখা যায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাজের সময় শেষ হলেও প্যাকেজ-১১ এর অগ্রগতি বর্তমানে ০ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বরে কাজের মেয়াদ শেষ হলেও প্যাকেজ-১৮ এর অগ্রগতি বর্তমানে ২৫ শতাংশ এবং প্যাকেজ-২১ এর অগ্রগতি ২১ শতাংশ। এই তিনটি প্যাকেজের কাজের ধীরগতির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আইএমইডিকে জানায় প্যাকেজ তিনটি শিগগিরই বাতিল করা হবে।
জানা যায়, প্রকল্পটি জুন ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে না পারায় জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইএমইডি থেকে এরইমধ্যে দু’একটি বিষয় জানতে চেয়েছে। আইএমইডি জানতে চেয়েছে এই প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের এডিপিতে কেন ওঠেনি এবং আমাদের কিছু অব্যয়িত টাকা কেন সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন আমাদের তহবিল পরিচালনার দাবিদার। আমরা জাস্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করি। তহবিলটা তারা দেখেন। আমাদের পিডিদের আর্থিক বা প্রশাসনিক কোনো ক্ষমতা নেই। সিটি করপোরেশনের কোনো পিডির আর্থিক বা প্রশাসনিক পাওয়ার নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে পিডি বলেন, ‘ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারেনি বলে বিল দিতে পারেনি। বিল দিতে না পারলে তো টাকা ব্যয় হবে না। টাকা ফেরত যাবে। তবে আমাদের কর্তৃপক্ষ বলেছে, টাকা আপাতত থাক, সরকার যদি বলে তাহলে আমরা টাকা ফেরত দেব। আমি টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বলেছি, কিন্তু আমাদের কোনো আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় আমার জায়গা থেকে কিছু করার নেই। আমার আর্থিক ক্ষমতা থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমাদের সব বিষয়েই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়রের কাছে উপস্থাপন করি। তারা অনুমোদন করলে আমরা সেটা করতে পারি, তা না হলে পারি না। আমার দায়িত্ব তাদের জানিয়ে ও মনে করিয়ে দেওয়া। এছাড়া কোনো ক্ষমতা নেই।’
টাকাটা বর্তমানে কার অ্যাকাউন্টে আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো রয়েছে। এই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার কোনো ক্ষমতা আমার কাছে নেই। সুতরাং এই টাকার যদি কোনো মুনাফা হয়েও থাকে তাহলেও আমার জানার বা তোলার ক্ষমতা থাকবে না। এই অ্যাকাউন্টের যা কিছু হবে সবকিছুই ওনাদের দুজনের এখতিয়ার।’
অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি টাকার বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কার্যক্রম চলমান ছিল। টাকা ফেরতের বিষয়টি আমাদের কেউ জানায়নি। মূলত ইঞ্জিনিয়ার শাখা থেকে আমাদের জানালে আমরা সেটা ফেরত দিয়ে দিতাম। ওরাও জানায়নি এজন্য আমাদেরও আর টাকাটা ফেরত দেওয়া হয়নি।’
চাহিদা অনুযায়ী টাকা পেয়েছেন, যদি খরচ না করতে পারেন তাহলে অর্থবছর শেষে টাকা সরকারকে ফেরত দেননি কেন এমন প্রশ্নে প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমরা জানতে পারিনি। সেজন্য ফেরতও দেওয়া হয়নি।’ ব্যাংকে রাখা টাকার লাভের অংশ কে নিচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, এই টাকার লাভের অংশ ব্যাংকেই আছে। লাভসহ সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আগামী সপ্তাহে ব্যাংকে রাখা টাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরত দেবে।’
টাকা এক বছর অ্যাকাউন্টে রেখে লাভের অংশ ভাগবাটোয়ারা করার উদ্দেশ্য ছিল কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার তো চিন্তাভাবনা ওইরকম না। আমরা এই বিষয়টা এভাবে চিন্তা করিনি। এই টাকার যেই লাভ হবে, সেটা অ্যাকাউন্টেই থাকবে এবং সেই টাকা সরকারের কাছে ফেরত যাবে।’ ওই টাকা আমাদের তোলার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
এক কোম্পানিকে ১০টি প্যাকেজের কাজ দিয়েছেন কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা মূল্যায়ন কমিটি করেছে, মূল্যায়ন কমিটি যেভাবে মূল্যায়ন করেছে সেভাবেই দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ত্রুটির বিষয়ে ওরা (পিডি) আমাদের কিছু জানায়নি। কোনো জায়গায় ত্রুটি মনে হলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের কোনো পছন্দের কোম্পানি নেই।’
টাকা ফেরত না দেওয়ার প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যখন একটি প্রকল্পের টাকা ছাড় হয়, তখন এটা রাখতে পারে বিল দেওয়ার আগ পর্যন্ত। যদি কাজ না হয় তাহলেও এই টাকা অনন্তকাল ধরে রাখা যাবে না। খরচ করতে না পারলে অর্থবছর শেষে টাকাটা সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থবছর শেষেও টাকা ফেরত না দেওয়ায় বিধিবিধানের ব্যত্যয় হয়েছে। এই বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কঠোরভাবে দেখা উচিত। প্রকল্পের টাকা বিল পেমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে রাখতে পারে। কিন্তু বিল পেমেন্ট হয়ে গেলে তো এই টাকা অর্থবছর শেষে আর রাখা যাবে না। এই ৩০ কোটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করা উচিত ছিল। সিটি করপোরেশনের এই কাজটি কোনোভাবেই সমর্থযোগ্য না।’
সিটি করপোরেশনের প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব প্রধান নির্বাহী ও মেয়র পরিচালনা করেন, এটা সমর্থনযোগ্য কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আমার আসলে সেভাবে জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, উন্নয়ন প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে সবকিছু থাকা উচিত। তবে বড় অফিসাররা এই বিষয়গুলো টেকওভার করে ফেলে। যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়।’