রাজধানীর ইডেন কলেজকে অনেকটা যেন মগের মুল্লুক বানিয়ে নিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সিটবাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ তার নামে। অথচ বহাল তবিয়তেই কলেজে নিজের প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন তিনি। এ নিয়ে শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের নেত্রীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি রুপা ও মিথিলা নামে দুই ছাত্রীকে রিভার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের অডিও ভাইরাল হয়। এরপর তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে সপ্তাহ না পেরোতেই এবার সেই ছাত্রীদের আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। আটকে রাখা অবস্থায় রিভা ওই দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সকালের দিকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের পর অবশেষে রিভার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন রুপা ও মিথিলা। কলেজের রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের একটি কক্ষে এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পরে প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা ওই দুই ছাত্রীকে উদ্ধার করেন। আমাদের সময়ের হাতে থাকা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী এবং শিক্ষক রুপা ও মিথিলাকে মঙ্গলবারের ঘটনা খুলে বলার জন্য নানাভাবে আশ্বস্ত করছেন। তারা জানান, ছাত্রলীগ সভাপতি তাদের আটকে রেখে ‘এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পায়ে টাইনা ছিঁড়ে ফেলব’ শিরোনামে
প্রকাশিত সংবাদ মিথ্যা এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে বলেন। ওই ঘটনার অডিও রেকর্ড করতে নির্দেশ দিয়েছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমনা মীম এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। স্বীকারোক্তি না দিলে বিবস্ত্র করে ভিডিও করে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেন রিভা। তখন দুই ছাত্রী রিভার লিখে দেওয়া স্বীকারোক্তি পড়তে বাধ্য হন। সেটি রিভা এবং তার সহযোগীরা রেকর্ড করেন।
ভুক্তভোগী দুই ছাত্রী বলেন, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করেন রিভা। অসুস্থ থাকলেও ছাড় দেন না তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই এই নিপীড়ন চলছিল। কিন্তু সেদিন প্রমাণ রাখার জন্য তিনি অডিও রেকর্ড করেন। ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমনা মীম তাকে কখনো এ ব্যাপারে নির্দেশনা বা পরামর্শ দেননি। এ সময় ভুক্তভোগী অপর ছাত্রীকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিতে বললে তিনি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, এই ভিডিও বাইরে ছড়িয়ে পড়লে তার নিরাপত্তা দেবে কে?
কলেজ সূত্র জানায়, সম্মেলনের প্রায় তিন বছর পর গত ১ মে রিভাকে সভাপতি এবং রাজিয়া সুলতানাকে সাধারণ সম্পাদক করে ইডেন ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রিভা। ইডেন কলেজের ফুটপাতে চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্য, বিনা কারণে ছাত্রীদের মারধর, ব্যক্তিগত কাজে সাধারণ ছাত্রীদের লাগানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কমিটি ঘোষণার পরেই রিভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল ছাত্রলীগের একাংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার প্রাচীন এই কলেজের ছাত্রীনিবাসগুলোতে মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আসন-বাণিজ্যের শিকার হয়ে আসছেন। এর বাইরে শিক্ষাজীবন শেষে অনেক শিক্ষার্থীও টাকার বিনিময়ে হলে থাকার সুযোগ নেন। দিতে হয় মাসিকভিত্তিতে ভাড়াও। অভিযোগ রয়েছে, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি কিছু কিছু আসনে বহিরাগত ছাত্রীদের থাকার অভিযোগ রয়েছে। নেত্রীদের মাধ্যমে হলে ওঠায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। হলে শিক্ষার্থীদের ওঠাতে ১০-১৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। তারপরেও ছোটখাটো অজুহাতে তারা ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা প্রায়ই গালাগাল এমনকি মারধরেরও শিকার হন। হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ জন্য ছাত্রীরা কোনো অনিয়মের প্রতিবাদ করেন না। হল প্রশাসনও চুপ।
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন তামান্না জেসমিন রিভা। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত চক্র এই চক্রান্ত করছে তাদের ছাত্রী সংগঠন দিয়ে। কলেজের দখল নিতে আমার ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নাটক তৈরি করছে।’ একজনকে আটকে রেখে জবানবন্দি নেওয়ার বিষয়ে রিভা বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সব ডিজিটাল কারসাজি মিথ্যাচার।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহান খান বলেন, ‘তামান্না জেসমিন রিভার যে অডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেটা দুঃখজনক। ওই অডিওর নেতিবাচক কথোপকথনের জন্য তিনি নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও ছাত্রীদের একটি কক্ষে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন করে বিবস্ত্র করার হুমকির তথ্য সামনে এসেছে। কোনো ব্যক্তির জন্য সংগঠন কলঙ্কিত হতে পারে না। এটি সত্য হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবেন বলে আশা করি।’ বিষয়টি নিয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি। ইডেন কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া দাশকে ফোন করা হলে তিনিও রিসিভ করেননি।