আচ্ছা কাল রাতে কী স্বপ্ন দেখলেন? বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকুক বা অবাস্তব হোক, কোনো না কোনো স্বপ্ন তো নিশ্চয়ই দেখেছেন? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন না, এমন মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে নেই বললেই চলে! তবে মানুষ কেন এই স্বপ্ন দেখে, তার কারণ কখনো খুঁজেছেন কি?
মনোবিদদের মতে, আমাদের যে অবচেতন ভাবনাচিন্তা, ভয় বা ইচ্ছা, তার প্রতিফলনই হলো স্বপ্ন। তবে স্বপ্ন সম্পর্কে অন্যান্য বিশ্বাসও রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস আর জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, প্রত্যেক স্বপ্নের মধ্যেই কোনো না কোনো অর্থ লুকিয়ে রয়েছে। তবে স্বপ্নে মানুষ অনেক কিছুই দেখে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল থাকে না বললেই চলে।
কী হলো, মাথায় জটলা লাগল মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই ঘুমাই, স্বপ্ন দেখি, ঘুম ভাঙে জীবনযাপনের ব্যস্ততা ও বাস্তবতার সামনে আসি। কিন্তু স্বপ্ন যে একটা ব্রেনের খেলা, সেটা তো কখনো ভেবে দেখিনি? আচ্ছা তাহলে বলি স্বপ্ন একটা বিশাল জগৎ, যে জগতে এই এখনই আপনি পদচারণা করবেন, আপনি জানবেন কী খেলা চলে আমাদের ব্রেনে, যার ফলে এত টক, মিষ্টি, ঝাল স্বপ্নের আবির্ভাব হয়।
হয়তো জেনে থাকবেন, স্বপ্ন নিয়ে যারা স্টাডি করে তাদের অনারিওলজি বলে। ভেবে দেখেছেন কি? স্বপ্নকে আপনি বন্ধ করতে পারবেন না, মাপতে পারবেন না, আপনি অন্য কারো স্বপ্ন দেখতেও পারবেন না। কেউ যদি নিজে থেকে না বলে তাহলে স্বপ্ন জানার কোনো উপায় নেই। ইনফ্যাক্ট, আমরা যে স্বপ্ন দেখি তার ৯৫ শতাংশ আমরা ভুলে যাই। কিন্তু এরপর ১৯৫২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সিকাগোর গবেষকরা একটা মজার তথ্য আবিষ্কার করলেন। তারা দেখলেন, মানুষের ঘুমের একটা সার্টেইন স্টেজে গিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই স্টেজে যখন তাকে জাগিয়ে দেয়া হয়, তখন সে জানায়, হ্যাঁ, সে স্বপ্ন দেখছিল।
ঘুমন্ত অবস্থায় চোখের মণি নড়াচড়া করা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, যাকে বলা হয় র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম)। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তার ঘুমের পুরো সময়ের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ ভাগ, ৯০ থেকে ১২০ মিনিট সময়ে এই র্যাপিড আই মুভমেন্ট হয়ে থাকে। ঘুমের যে সময়টায় আপনার র্যাপিড আই মুভমেন্ট চলে অর্থাৎ স্বপ্ন দেখেন, তখন আপনার মস্তিষ্কের একটি অংশ শরীরকে কিছুটা অসাড় করে দেয়, যাতে স্বপ্নে আপনার নড়াচড়াগুলো প্রকৃত শরীরের ওপর কোনো প্রভাব না ফেলে। অর্থাৎ স্বপ্নে আপনি এক জায়গা থেকে হেঁটে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছেন খুব সহজেই, কিন্তু আপনার দেহ বিছানায় যেভাবে শুয়ে ছিলেন সেভাবেই আছে, এটা সম্ভব হচ্ছে কেবল মস্তিষ্কের ওই অংশের মাধ্যমে, যা আপনার দেহকে অসাড় করে রাখে। কিন্তু এটা ততক্ষণ পর্যন্তই চলে, যতক্ষণ আপনার মস্তিষ্কের সে অংশটি জেগে থাকে। আর যখন সে অংশটিও আপনার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই আপনি স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিছানা থেকে পড়ে যান।
আমরা কেন স্বপ্ন দেখি–এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
১. আমাদের অবচেতনের ভাবনাচিন্তা, ভয় বা ইচ্ছার প্রতিফলন হলো এই স্বপ্ন।
২. প্রত্যেক স্বপ্নের মধ্যেই কোনো না কোনো অর্থ লুকিয়ে রয়েছে।
৩. মানুষ এংজাইটি বা ভালোলাগা থেকেও স্বপ্ন দেখতে পারে।
৪. মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, তবে সব স্বপ্ন মনে রাখতে পারে না।
সাইকো-অ্যানালিসিস বা মনোসমীক্ষণের জনক সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেন, স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অবচেতন মনই আসলে কথা বলে আমাদের সঙ্গে। ফ্রয়েডের ধারণা, আমাদের স্বাভাবিক জীবনে যেসব আকাঙ্ক্ষা, তাড়না, অনুভূতি, চিন্তা আমরা প্রকাশ করতে পারি না, ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নের মাধ্যমে সেসব প্রকাশ পায়।’
কিছু মনে রাখার জন্য স্বপ্নের জুড়ি নেই । অবাক হচ্ছেন? মেন্টাল টাস্ক-এর পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য স্লিপ ইজ গুড বাট ড্রিমিং ইজ বেটার। ২০১০ সালে গবেষকরা দেখেন, যারা পড়াশোনার কোনো বিষয় জানার পর তা স্বপ্নে দেখেন, তাদের ধারণা অন্যদের থেকে অনেক বেশি ক্লিয়ার। মানুষ মূলত স্বপ্ন দেখেই ভুলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এই স্বপ্ন মানুষের সাইকোলজিক্যাল হেলথকে ভালো রাখে। স্ট্রেস রিলিজ করে। মানুষ তার জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্যও স্বপ্ন দেখে। কীভাবে জানেন কি? স্বপ্নের মাঝে একটা সমস্যার অসংখ্য পথ বা সমাধান আপনার সামনে আসতে পারে, যা হয়তো আপনার জাগ্রত অবস্থায় মাথায়ই আসত না।
একটি মজার তথ্য শুনলে অবাক হবেন, আমরা অনেকেই হয়তো ভাবি নারী-পুরুষ উভয়েই একই রকম স্বপ্ন দেখে। আবার এমনটাও মনে করি, পুরুষের স্বপ্নে হয়তো সুন্দরী মেয়েরাই বেশি আসে, বা নারীরা হয়তো স্বপ্নে স্মার্ট ছেলেদেরই বেশি দেখে। এমনটা আপনিও যদি ভেবে থাকেন তবে দুটি ধারণাই ভুল। পুরুষ ও নারী উভয়ের স্বপ্ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পুরুষের স্বপ্নের ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে অন্য পুরুষ চরিত্র। অন্যদিকে, নারীদের স্বপ্নে নারী এবং পুরুষ উভয় চরিত্রের উপস্থিতি সমান। আবার পুরুষের স্বপ্নে অনুভূতির প্রকাশ নারীদের স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি কড়া হয়।
মানুষ স্বপ্ন দেখে, এটাই স্বাভাবিক। তবে জানেন কি, প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখে। বিভিন্ন প্রাণীর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর ধারণা করা হচ্ছে, প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখে। আপনি যদি আপনার পোষা প্রাণীটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় খেয়াল করেন, দেখবেন সেটি ঘুমন্ত অবস্থায় থাবা নাড়ায়, মুখে শব্দ করে বা এমন কোনো ভঙ্গি করে, যা দেখে মনে হতে পারে সে কারো সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।
স্বপ্নে ভবিষ্যৎ জানা যায় বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করেন। পৃথিবীর বেশ কিছু স্থানে বিভিন্ন মানুষের ওপর চালানো জরিপের ফলাফল এমনটাই দেখায়। দেখা যায়, যাদের নিয়ে জরিপ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত মানুষ দাবি করেছেন যে তারা জীবনে অন্তত একবার হলেও স্বপ্নে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন এবং জরিপে অংশগ্রহণ করা মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশেরই দেখা স্বপ্ন পরে বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেছে, যা তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে আরেকটি প্রশ্ন ছিল: ‘স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখা বা জানা যায়’–এই কথায় বিশ্বাস করেন কি না? ফলাফলে দেখা যায়, জরিপ ভেদে ৬৩ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ এই কথায় বিশ্বাস করেন।
একদিন হয়তো সত্যিই এমন টেকনোলজি আবিষ্কার হয়ে যাবে, যখন মানুষ স্বপ্ন ও তার সঠিক কারণ জানতে পারবে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকুন আর ততদিন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে থাকুন।