গাজীপুরে প্রাইভেট কারের ভেতরে শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তাদের মরদেহের ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শাফি মোহাইমেন জানান, বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) বিকেলে মরদেহ দুটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। এ সময় দুইজনের ফুসফুস ও কিডনিতে প্রায় একই রকম লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাদের প্রত্যেকের ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে। এটা সাধারণত খাবারে বিষক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। তাই তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য নমুনা ঢাকাস্থ সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরে টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোসাম্মৎ মাহমুদা আক্তার জলির মরদেহ গাজীপুর মহানগরের গাছার দক্ষিণ খাইলকুরের বগারটেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়।
শিক্ষক দম্পতির ছেলে একেএম তৌসিফুর রহমান মিরাজ সাংবাদিকদের জানান, গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়ি থেকে বুধবার (১৭ আগস্ট) সকালে একই প্রাইভেট কারে শিক্ষক দম্পতি তাদের স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হন। স্কুল শেষে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু এরপর থেকে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বজনরা রাতভর খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সন্ধান পায়নি। ভোর রাতের দিকে গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুর বগার টেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির ভেতর চালকের আসনে প্রধান শিক্ষক ও পাশের আসনেই তার স্ত্রীর নিথর দেহ দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়। তাদের প্রথমে বোর্ডবাজার এলাকার তায়রুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উত্তরার অপর একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ তাদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
শিক্ষক জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেন, ইতোপূর্বে গাজীপুরের কালীগঞ্জের পুনসই হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিল জিয়াউর রহমান। সেখান থেকে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিল। তার স্ত্রী মোসাম্মৎ মাহমুদা আক্তার জলিও টঙ্গী বাজার এলাকার আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিল। তারা সপরিবারে গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়িতে থাকতো।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তারা দুজনেই স্কুলে যাওয়া আসা করতো। বুধবার স্কুল শেষে সহকর্মী ও সম্পর্কিত মামাতো ভাই মো. কামরুজ্জামানকে (গণিতের শিক্ষক) গাড়িতে তুলে নিয়ে জিয়াউর স্ত্রী জলির স্কুলে যায়। সেখান থেকে স্ত্রী জলিকে গাড়িতে তুলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথে কামরুজ্জামানকে নামিয়ে দেয় জিয়াউর। জিয়ার ছেলে মিরাজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেয়। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার মায়ের ফোনে কল করে। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসছে বলে জানায়। কিন্তু মা কথা বলার সময় ক্লান্তির স্বর ভেসে আসছিল। এরপর থেকে ফোনে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি।
টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. নুরুজ্জামান রানা বলেন, প্রধান শিক্ষক একেএম জিয়াউর রহমান ও কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। জিয়াউর স্যার গাছা থানার কামারজুরি এলাকায় এবং কামরুজ্জামান টঙ্গীর শিলমুনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কামরুজ্জামান একই স্কুলের গণিতের সহকারী শিক্ষক। জিয়াউর স্যারও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। কামরুজ্জামান হেড স্যারকে মামাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন। তবে স্বামী-স্ত্রী কিংবা স্কুলের সকল শিক্ষকের সঙ্গেই জিয়া স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিল। কারো সঙ্গে কখনো বিরোধ ও খারাপ সম্পর্কের কথা শুনিনি।
সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান বলেন, স্কুলের পাশে প্রাইভেট পড়ানো শেষ করে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে স্কুলে টয়লেট ব্যবহার করতে যাই। টয়লেট সেরে স্কুলের গেটের কাছে গেলে হেড স্যার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্কুল থেকে বের হন। পরে তিনি পথে নামিয়ে দেবেন বলে তার গাড়িতে উঠতে বলেন। আমাকে নিয়ে ম্যাডামকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন হেড স্যার। হেড স্যার নিজেই গাড়ি চালান। পথে টঙ্গী বিসিকের সাহারা মার্কেট এলাকায় গিয়ে আমাকে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে নামিয়ে দিয়ে তারা চলে যান। এরপর আমার সঙ্গে তাদের আর কথা বা দেখা হয়নি।
কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার পলাশতলি গ্রামে। তিনি শিলমুন এলাকায় ভাড়া বাসায় সপরিবারে বসবাস করেন। আর জিয়াউর রহমান গাছা থানার কামারজুরি এলাকায় নিজ বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করেন। তার গ্রামের ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায়।
জিয়াউর রহমানের বড় ভাই মো. রিপন বলেন, এ হত্যাকাণ্ডটি পুরাই ‘পরিকল্পিত’। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই খোয়া যায়নি। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না-ই হতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেত। তার কিছুই তারা নেয়নি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনাটি তদন্তে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।