ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধিতে চাল উৎপাদন ব্যাহত হবে

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে সরকারের। খাদ্যঘাটতি মেটাতে আবাদি জমি অনাবাদি না রেখে চাষাবাদ এলাকা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু চলতি বছরের দুই দফা বন্যায় আউশ আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোপা আমনের বীজতলা। অন্য দিকে ভরা মওসুমেও অনাবৃষ্টি বা খড়ার কারণে পিছিয়ে গেছে রোপা আমন চাষ। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বৃষ্টি হলেও তা চাহিদা মিটছে না কৃষকের। ফলে গভীর ও অগভীর নলকূপ ব্যবহার করে সেচকার্য চালাতে হচ্ছে কৃষকের। এরই মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে সেচ কার্যক্রমও ব্যাঘাত ঘটছে। আর তার সাথে নতুন করে কৃষকের ওপর ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত দামের বোঝাও চেপেছে গতকাল থেকে। খুচরা পর্যায়ে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এটাকে কৃষকের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো: জাহাঙ্গীর আলম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে প্রথমে আমন এবং পরে বোরো চাষাবাদ এবং কাক্সিক্ষত খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। দেশে চালের ঘাটতি বাড়বে এবং আমদানি নির্ভরতা আরো বাড়বে। এই সময়ে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো একেবারেই অযৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমানে আউশের ভরা মওসুম চলছে। আমন ধান রোপণেরও ভরা মওসুম এখন। দেশে চাষাবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৪ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ৫৯ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে রোপা আমন ধান চাষ হয়। জুলাই-আগস্ট মাস আমন ধান রোপণের মওসুম। জুলাইয়ের শেষ হতে কিছুটা বৃষ্টিপাত হলেও তা সেচ চাহিদা মেটাচ্ছে না কৃষকের। বৃষ্টির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত সেচযন্ত্র দিয়ে ক্ষেতে পানি দিয়ে আমন ধান রোপণ করছেন চাষিরা। বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান আবাদ এবার সেচনির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং কৃষককে ভোগাচ্ছে। কাক্সিক্ষত খাদ্য উৎপাদন নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ অবস্থায় গতকাল সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপকরণ-১ অধিশাখা থেকে বিএডিসি এবং বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) প্রধানকে চিঠি দিয়ে প্রতিষ্ঠান দু’টির সেচসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সেচের পানি সরবরাহে যেন ঘাটতি তৈরি না হয় এবং ফসল উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করাসহ আরো কিছু নির্দেশনা রয়েছে এই চিঠিতে। এতে আরো বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সর্বত্র যৌক্তিক লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়। বিশেষ করে চলমান আউশ মওসুমে ধানের স্বাভাবিক উৎপাদন ও আসন্ন আমন মওসুমে তা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় সেচব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ কৃষি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

কৃষি উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে এমন চিঠি ইস্যুর দিনই ইউরিয়া সারের মূল্য কেজিতে ছয় টাকা বাড়াতে আরেকটি নির্দেশনা এসেছে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। এতে বলা হয় ইউরিয়া সারের ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এবং চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ খুচরামূল্য প্রতি কেজি ১৪ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৬ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করেছে সরকার। পুনর্নির্ধারিত এ মূল্য গতকাল থেকেই কার্যকর করা হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়ার সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। এর ফলে ছয় টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের ভর্তুকি ছিল মাত্র ১৫ টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সারের মূল্য চার দফা কমিয়ে অত্যন্ত স্বল্প দামে পর্যাপ্ত সার কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। ডিএপি সারে শতকরা ১৮ ভাগ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সেজন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ডিএপি ব্যবহার হতো ৮ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ লাখ টন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ার ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমেনি বরং বেড়েছে। ২০১৯ সালে ইউরিয়া ব্যবহার হতো ২৫ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। অন্য দিকে বিগত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশে সারে প্রদত্ত সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা; সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।’

কৃষি মন্ত্রণালয় আরো জানায়, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমন মৌসুমে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ছয় লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন; বিপরীতে বর্তমানে মজুদ রয়েছে সাত লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। যা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় এক লাখ টন বেশি। অন্যান্য সার যেমন টিএসপির আমন মৌসুমে চাহিদা এক লাখ ১৯ হাজার টন, বিপরীতে মজুদ তিন লাখ ৯ হাজার টন। ডিএপির চাহিদা দুই লাখ ২৫ হাজার টন, বিপরীতে মজুদ ছয় লাখ ৩৪ হাজার টন এবং এমওপির চাহিদা এক লাখ ৩৭ হাজার টন, বিপরীতে মজুদ রয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার টন।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো: জাহাঙ্গীর আলম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোতে প্রথমেই আমন ধানে বিরাট প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকরা, বেশি দামের কারণে সার কম ব্যবহার করবে। ফলে উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরপরই বোরো মৌসুমে আসছে। তখন ইউরিয়া সারের ব্যবহার বেশি হয়। তখন অনেক কৃষক ঠিক মতো ইউরিয়া দিতে পারবে না। তখন বোরো ধানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সারের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন কমে যাবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘিœত হবে। আমরা এ বছর ১০-১৫ লাখ টন চাল আমদানি করছি। আগামীতে আমদানি আরো বেড়ে যাবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে খাদ্যশস্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে, সেখানে আমদানিটাও অনেকটা অনিশ্চিত। কাজেই চাল আমদানিতে নির্ভরশীল না হয়ে উপকরণের দাম কমিয়ে রেখে উৎপাদন বাড়ানোই হলো যুক্তিযুক্ত কাজ।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, এখন তো আন্তর্জাতিকভাবে ইউরিয়া সারের দাম হ্রাস পাচ্ছে। দুই চার মাসের মধ্যে হয়তো দামটা কমে যাবে। কাজেই এত তাড়াহুড়ো করে ইউরিয়ার দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারত সরকার। ড. জাহাঙ্গীর বলেন, দেশে দু’টি সার কারখানা বন্ধ। গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। একসময় আমরা ৮০ শতাংশ ইউরিয়া সার উৎপাদন করতাম, এখন তা ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণভাবে সার উৎপাদন বাড়ালে কৃষির উৎপাদন খরচও কমবে। উৎপাদন বাড়িয়ে সারে বাইরের ওপর নির্ভরতা কমানো উচিত। সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের হাতের নাগালে রাখা উচিত, যাতে খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন সহজ হয়।

এ বিষয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশের (খানি) সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি সরাসরি কৃষি ও কৃষকের উপর প্রভাব পড়বে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। কৃষকদের মধ্যে দারিদ্র্য তৈরি হবে। বেশির ভাগ কৃষকই দেখা যাবে বেশি দামের সার কিনতে পারছে না। ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকের ওপর প্রভাব পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *