জিম্বাবুয়ে সফরে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলের নতুন অধিনায়ক হলেন নুরুল হাসান সোহান। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ‘বিশ্রাম’ দিয়ে তরুণ এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটারকে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ দল। সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজটি ২-০ (একটি পরিত্যক্ত) ব্যবধানে হেরেছেন টাইগাররা। এদিকে মাত্র ৩৩টি টি-টোয়েন্টি (৭টি টেস্ট ও ৬টি ওয়ানডে) খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে নুরুলের। তবে তাকে দিয়ে হয়তো সাময়িক সময়ের নেতৃত্ব শূন্যতা কাটাতে চাইছে বিসিবি।
নুরুলের সামনে অবশ্য চ্যালেঞ্জ থাকছে। প্রথমত দলকে একসুতোয় গাঁথতে হবে। ড্রেসিংরুমে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো- দলকে জয়ে ফেরানো। শেষ চার ম্যাচের তিনটিতে (একটি পরিত্যক্ত) যে হেরেছে দল।
বাংলাদেশ দল সর্বশেষ জিম্বাবুয়ে সফর করেছে গত বছর। সে সফরের টি-টোয়েন্টি সিরিজে সিনিয়রদের মধ্যে ছিলেন সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ। মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বে তিন ম্যাচের সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জিতেছিলেন টাইগাররা।
কে এই নুরুল হাসান?
২৮ বছর বয়সী উইকেটরক্ষক-ব্যাটার নুরুলের ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। যদিও প্রায় ৬ বছরের ক্যারিয়ারে খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেননি। তবে টেকনিক্যালি উইকেটরক্ষক হিসেবে তার দারুণ দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু দলে যে মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাসের মতো অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক রয়েছে, যারা তিন ফরম্যাটেই ভাগাভাগি করে জায়গাটি দখল করে রাখেন।
নুরুল অবশ্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে যখনই সুযোগ পান, তখনই নিজের জায়গার সামর্থ্য প্রমাণ করতে চান। সম্প্রতি এই ডানহাতি ব্যাটার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কঠিন পেস অ্যাটাকের বিরুদ্ধে বেশ ভালোই লড়াই করেছেন। ওয়ানডেতেও দারুণ ব্যাট করতে দেখা যায়। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্সে খোদ ওডিআই অধিনায়ক তামিম ইকবাল তার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বোলারদের বাদ দিলে নুরুল ছিল সেরা পারফর্মার। তাকে ব্যাট হাতে শক্ত পজিশনে দেখা গেছে।’
৩৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ১২.৯০ গড়ে ২৭১ রান করেছেন সোহান। সর্বোচ্চ ৩০*। স্ট্রাইকরেট ১১১.৯৮। ২০১৭ সালের পর ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ে সফর দিয়েই আবার দলে জায়গা করে নেওয়া সোহানের শেষ ৬ ম্যাচে রান ২৮, ১১, ৪, ২৫, ৭, ২*।
অধিনায়ক হিসেবে নুরুলের অভিজ্ঞতা
নুরুলের ঘরোয়া ক্রিকেটে সাদা বলে মূলত অভিজ্ঞতার ভালো ছাপ পাওয়া যায়। তিনি শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবকে ৪৯টি সাদা বলের ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার অধিনায়কত্বে শেখ জামাল প্রথমবার চ্যাম্পিয়নও হয়। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি খুলনা বিভাগ ও সাউথ জোনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১৯ সালে বিপিএলের একটি ম্যাচে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের অধিনায়ক হয়েছিলেন নুরুল। তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার নেতৃত্ব খুবই কম।
এ নিয়ে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেন, ‘তার ঘরোয়া ক্রিকেটে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার মাঝে আক্রমণাত্মক মনোভাব রয়েছে, যা দলকে অনুপ্রাণিত করবে।’
তবে নুরুলের এই নেতৃত্ব হতে পারে শুধুমাত্র জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আসন্ন তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টিতেই। এই সিরিজে মাহমুদউল্লাহ বিশ্রামে রয়েছেন। তবে আগস্টের শেষ দিকে এশিয়া কাপে মাহমুদউল্লাহ নেতৃত্বে ফিরবেন কিনা সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা নেই। টি-টোয়েন্টি টাইগারদের নতুন অধিনায়ক হতে পারেন সম্প্রতি টেস্টের নেতৃত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসান। তবে বিসিবি এনিয়ে কিছুই জানায়নি।
এরপরেই হয়তো সাকিব
ভাবা হচ্ছে নুরুল শুধুমাত্র সাকিবের জায়গাটাতেই আপাতত বসেছেন। মাহমুদউল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া বড় কারণ হচ্ছে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের ভরাডুবি। যেখানে বাংলাদেশ সুপার টুয়েলভে সব ম্যাচেই হেরেছিল। এমনকি প্রাথমিক পর্বে স্কটল্যান্ডের মতো দলের কাছেও হারতে হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বকাপের পর বিসিবি মাহমুদউল্লাহকে সরায়নি। পরে তিনি আরও তিনটি সিরিজে নেতৃত্ব দেন। তবে এসময় টাইগাররা ৮ ম্যাচে মাত্র একটিতে জয় পায়।
নেতৃত্বে বাইরে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং পারফরম্যান্সও ভালো ছিল না। ২০২১ সালের অক্টোবরের পর থেকে তিনি ৩০ রানের কোনো ইনিংস খেলতে পারেননি। শারজায় তার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩১ রানের ইনিংসটি সবশেষ সেরা ইনিংস। যদিও পরে তার ১০ ইনিংসে সেরা ছিল মাত্র ২২!
সাকিব ইতোমধ্যে টেস্টের নেতৃত্ব বুঝে পেয়েছেন। উইন্ডিজ সফরের আগেই এই ফরম্যাটে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন মুমিনুল হক।
তবে সবকিছু পরিস্কার হচ্ছে না কেন?
সাকিব জিম্বাবুয়ে সিরিজে বিশ্রাম চেয়েছেন। জানা যায়, এই সিরিজে তিনি থাকলে সেই হতেন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের অধিনায়ক। তাকে না পেয়ে বিসিবি নুরুল ও লিটনের সঙ্গে টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা করে। লিটন গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক হয়েছিলেন। তবে বিসিবির কাছে নুরুলের নেতৃত্বে যোগ্যতা আরও বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।
নুরুলের কাছে দলের চাওয়া?
হয়তো খুব বেশি না। তিনটি ম্যাচ খুব বেশি না। তবে নুরুলকে অধিনায়ক ঘোষণা করার সময় বিসিবি একটি ভিন্ন দিক উল্লেখ করেছে। টি-টোয়েন্টিতে এমনিতেই বাংলাদেশ ভালো দল না। তারা এই ফরম্যাটে টেকনিক্যাল ও শারিরীক ভাবে শীর্ষ দলগুলোর থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের অবস্থান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ফলে এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপেও দলের আশা হয়তো খুব বেশি না। কিন্তু বিসিবি মনে করেছে নুরুলের আক্রমণাত্মক মনোভাব যদি দলের কাজে লাগে, তবে সাকিব এই দলটাকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
সোহান চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) ভাইদের অনুপস্থিতি আমাদের নতুন কিছু করার একটি সুযোগ করে দিয়েছে। দলকে কীভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটি নিয়ে ভাবছি। আমার কাছে দলগত পারফরম্যান্সটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানি, বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। আমি এ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি। আশা করি ভালোভাবেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারব।’
সিনিয়রদের এগিয়ে আসতে হবে, যদিও তাদের কেউ নেই এই সিরিজে
অতীতের প্রতিটি সাফল্যে সিনিয়র ক্রিকেটারদের অধিকাংশই দলে ছিলেন। এবার তারা কেউ-ই নেই। অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডবদের (মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ) মধ্যে কাউকেই পাচ্ছেন না নতুন অধিনায়ক সোহান। টি-টোয়েন্টি থেকে ইতোমধ্যে তামিম অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। শেষ ১৫ বছরে মাহমুদউল্লাহ ছাড়া টাইগাররা মাত্র ১০টি টি-টোয়েন্টি খেলেছে। এই সিরিজে মুশফিকুর রহিমও বিশ্রামে।
বাংলাদেশ এখনও কোনো ওপেনার পায়নি, যাকে তামিমের পরিবর্তে খেলাতে পারবে। তবে মিডলঅর্ডারে অবশ্য সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের পরিবর্তে বেশ কয়েকজন ব্যাটার রয়েছেন। বিসিবি বিশ্বাস করে নতুনদের বা দলে ডাক পাওয়া ক্রিকেটাররা দ্রুত জ্বলে উঠবে। যারা আসছে এশিয়া কাপ, নিউজিল্যান্ডে ত্রি-দেশীয় সিরিজ ও বিশ্বকাপে জায়গা ধরে রাখবে।
আগামী মঙ্গলবার জিম্বাবুয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন টাইগাররা। সফরে তিন টি-টোয়েন্টির সঙ্গে থাকছে সমানসংখ্যক ওয়ানডে ম্যাচও। আগামী ৩০ জুলাই প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে মাঠে গড়াবে সিরিজ। বাকি দুই টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ৩১ জুলাই ও ২ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে।