লোডশেডিং : কার স্বার্থে

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


গত শুক্রবার (২২ জুলাই) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা এক সপ্তাহ বা ১০ দিন লোডশেডিং পর্যবেক্ষণ করব। এর পর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হবে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে ১ বা ২ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রীর তথ্যই আমাদের কাছে যথার্থ বলে মনে করি। কারণ তারাই নিয়ন্ত্রক। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমগুলোর দেওয়া সংবাদ ওই সত্যকে উল্টে দিচ্ছে। বাজারগুলোয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। এলাকা ভিত্তিতে লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও এক ঘণ্টা, কোথাও দুই ঘণ্টা। কোনো এলাকায় দিনে একাধিকবারই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জনজীবন নাস্তানাবুদ হচ্ছে। গ্রামস্তরে ৪-৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। সেটি প্রতিমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন।

প্রচ- তাপদাহে এমনিতেই জীবন অতিষ্ঠপ্রায়। তেষ্ঠায় ক্লান্ত রিকশাচালক, ঠেলাওলারা। মাটিকাটা শ্রমজীবীরা কাজে যেতে পারছেন না। পথচারীদের দরদরিয়ে ঘামতে দেখা যাচ্ছে। মসজিদে এসি চলছে বটে তবে তা খানিক সময়ের জন্য। গরমের দিনগুলোকে যতই মধুমাস বলা হোক না কেন, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ্যমাসের আম-জাম-কাঁঠালসহ নানা ফলের সমাহার ঘটলেও স্বস্তি নেই মহানগর ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরগুলোয়। রোদের তাপের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।

লোডশেডিং কবে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারেন না, এমনকি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও বলেননি। তা হলে কি অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ব্যবস্থা চালু হলো? নাকি জ্বালানি সংকট কেটে গেলেই আবারও সচল হবে বন্ধ করে রাখা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো? ডাবল সাইকেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেন পুরো সময় চালু রাখা হচ্ছে না? কেন রেন্টাল, কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে? এগুলো কি হাওয়া দিয়ে চলে? নাকি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলে চলে?

এটি আমরা সবাই জানি, বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। ধনী দেশগুলো ওপেক নেতাদের অনুরোধ করেছেন- যাতে তারা প্রতিদিন ১৩ কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদন করেন। সেটি হলে আপাতত যে জ্বালানি সংকট চলছে, তা কেটে যাবে। এটিও আশার কথা সংকটে ভোগা দেশগুলো জন্য। কিন্তু কবে নাগাদ এই সংকট থেকে বিশ্ব বেরিয়ে আসতে পারবে, এর কোনো জবাব কারও কাছে নেই।

রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর থেকেই মূলত সংকট শুরু হয়। ২১ জুলাই রাশিয়ার গ্যাসলাইন ওপেন হয়েছে জার্মানির জন্য। এতে কি রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্য এবং সংহতি শিথিল হয়ে গেল? নাকি জার্মান রাশিয়ার ওপর দেওয়া মার্কিনি বাণিজ্য অবরোধ মানছে না? এ সংকট কাটিয়ে ওঠার মধ্যেই আসলে রয়েছে জ্বালানি সংকটের সমাধান। রাশিয়ার জ্বালানি ছাড়া ইউরোপ যে প্রায় অচল, তা তো শাদা চোখেই দেখা গেল। রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রি না করলে চলবে না। অর্থাৎ বিষয়টি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এখন ইউক্রেনকে বাঁচাতে গিয়ে আমেরিকা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আসলে কতটা পোক্ত থাকবে জো বাইডেন হয়তো তলিয়ে দেখেননি। আবার তার আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে- রাশিয়ার পাশে আছে চীন, আছে ইরান, আছে আমেরিকার ওপর নানা কারণে নাখোশ এশিয়ার দেশগুলো। ফলে অর্থনৈতিক শক্তির বিচারেও রাশিয়াকে কাবু করা যায়নি।

এখন আমরা যেসব দেশ থেকে জ্বালানি কিনি, সেসব দেশের তেলের উৎপাদন কোভিড ও পোস্ট কোভিডকাল থেকেই কমেছে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, বাজারে তেলের চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন ও সরবরাহ মিল না হলে দাম বাড়বেই। তেলের দাম ১৪০ ডলার পর্য়ন্ত উঠে যাওয়ায় ভোক্তা, ব্যবহারকারী বা ক্রেতাদেরও চোখে শর্ষে ফুল দেখার শামিল। তবে এখন দাম কিছুটা কমে এসেছে। এটিকে স্বস্তির বৃষ্টির মতো বলতে পারি। বাংলাদেশে তাপদাহের দীর্ঘযাত্রার পর স্বস্তির বৃষ্টি মনে আশা জাগিয়েছে যে, আমাদের জনজীবন শান্তির ঠিকানা বোধহয় পেল। কিন্তু বৃষ্টি হলেও যে স্বস্তি ও আশা জেগেছিল, তা আমাদের প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য কমে এলেও তা আশা জাগিয়েছে ঠিক কিন্তু স্বস্তি দিতে পারেনি।

বিষয়টি যেখানে বাণিজ্যের, লাভ ও লোকসানের- সেখানে মানবতা শব্দটি উহ্যই থেকে যায়। যদি মানবতাই প্রধান হতো, তা হলে ভ্লাদিমির পুতিন কেন ইউক্রেনে হামলা চালাবে? লাভ ও লোভ হচ্ছে দুই সহোদরের মতো। ক্ষমতা ও লোভ হচ্ছে তাদেরই বৈমাত্রেয় ভাই। আমরা যেভাবেই বিষয়টি বর্ণনা করি না কেন, রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বিশ্ব অস্ত্রবাণিজ্য ও জ্বালানি বাণিজ্যের অধিপতিরা। বাণিজ্যের এই আধিপত্য বিস্তারের এ খেলা মূলত মরণঘাতী। এ পথ থেকে কোনোভাবেই পুতিনকে সরানো যাবে না। সরাতে বা সরে যেতে চাইলেই তার পতন অনিবার্য় হয়ে উঠবে। ঠিক এরই মাঝখানে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান টলটলায়মান।

আমাদের এত বিত্ত নেই যে, ওই অর্থ দিয়ে বাড়তি দামে জ্বালানি কিনবে। তাই প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা নতুন বাজার খুঁজছেন। কিন্তু এটি যে কথার কথা- তা তিনিও জানেন, আমরাও জানি। জ্বালানির উৎপাদক দেশগুলোর অধিকাংশই তো মুসলিম দেশ। আমাদের দেশটিও মুসলমানদের। তা হলে তারা কেন আমাদের সংকটে পাশে দাঁড়াবে না। দাঁড়াবে না এ কারণেই যে, তারা হিসাবটা মুসলমানিত্বের সঙ্গে বাণিজ্যকে এক করে দেখে না। কুয়েত ও কাতারের জ্বালানি আমরা কিনি বৈশ্বিক দামেই। এমনকি এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও) কিনি ওই রেটেই। দেশে উৎপাদিত এলএনজির দাম অনেক কম পড়লেও কোনো এক কারণে আমদানিই ভরসা আমাদের। আবার ডিজেল আমদানি করি আমরা। সরকার করে, বেসরকারি উদ্যোক্তারাও ডিজেল আমদানি করে। খোলাবাজারে ডিজেলের দাম ৮৩ টাকারও বেশি। অথচ আমদানি মূল্য অনেক কম। দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলে ডিজেলে আর ফার্নেস অয়েলে। মোট ডিজেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করে বেসরকারি আমদানিকারকরা। ১০ শতাংশ আমদানি করে সরকার। দামের এ বৈষম্যই যে কী কারণে, তা কি বোকা জনগণ বোঝে না? সরকার কেন নিজের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেনে, তাও বোঝে না জনগণ!

দুই

২০১৬ সালে একবার সমস্বরে বলতে শোনা গিয়েছিল, দেশে গ্যাসের মজুদ নিঃশেষপ্রায়। ওই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হারিয়ে যেতে যেতেই শোনা গেলে বিদ্যুৎ আমদানির কথা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা তখনই শুরু হয়েছে। পরে চুক্তিও হয়েছে। ল্যান্ডিংস্টেশনও তৈরি হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতীয় বিদ্যুৎ ল্যান্ড করলেই সংকট বহুদূরে চলে যাবে। এর মধ্যেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালু হবে। সুন্দরবন ধ্বংস হোক বা না হোক, বনের উপান্তে কয়লা পোড়ালে এর ছাই সুন্দরবনকে কিছুটা হলেও ক্ষতি করবেই। ভারতীয় টেকনোলজির ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তাদেরই কয়লায় চলবে। অর্থাৎ আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্যুতের লোডশেডিং আবারও জাদুঘরে চলে যাবে বলেই বিদ্যুৎ নেতারা আশা করছেন। তাদের আশ্বাস বাণী আমরা বিশ্বাস করি। প্রতিবারই ওই আশ্বাস বাণী দুরাশায় পরিণত করে চলেন তারা। কারণ তাদের রয়েছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। এবার বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মোংলা নৌবন্দর ব্যবহারের আবদার। ওই আবদার বাংলাদেশ রক্ষা করবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

তিন

আমাদের সামাজিক মানুষের কোনো লজ্জা-শরম নেই। তাই বারবার শঙ্কা প্রকাশ করি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এত ছিল যে, গর্বে সিনা ফুলে উঠেছিল। এ কারণেই তো অর্থমন্ত্রী বলেন, নেই নেই করেও তো আমাদের মজুদ ৪০ হাজার কোটি ডলার আছে। কিন্তু ওই ৪০ হাজার কোটি ডলারে আমদানি ব্যয় কতদিন চলবে, তা তিনি বলেননি। আমদানির টুঁটি চেপে ধরলেই কি এর সমাধান হবে? নাকি রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি করার বিষয়টি জরুরি? আর যে রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে- এর মধ্যে যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, শ্রীলংকা ও সুদানকে দেওয়া ঋণ প্রভৃতি যে কাজির খাতায় আছে, গোয়ালে নেই; তা নিশ্চয় অর্থমন্ত্রী জানেন। আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছিল রিজার্ভ হিসাব সংস্কার করতে। কিন্তু বাংলাদেশ সরাসরি তা নাকচ করে দিয়ে বলেছে, আমরা আমাদের মতো করে হিসাব করব। আমাদের মতো হিসাব করলে তো সাড়ে ৪০ হাজার কোটি দেখানো যায়। আর আইএমএফের হিসাবে ওই রিজার্ভ নেমে আসে সাড়ে ৩২ হাজার কোটি কিংবা ৩৩ হাজার কোটিতে। এ রিজার্ভ জনগণকে আতঙ্কিত করতেই পারে। কেননা জনগণ খুবই ভীতু প্রকৃতির। এর ওপর যদি শাসনধারা টাইরান্ট হয়- মানে, কর্তৃত্ববাদী হয়; তা হলে শামুকের মতো গুটিয়ে থাকাই তো শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি, তাই নয় কি? আর যাই হোক, রাজনৈতিক গলাবাজি ও প্রকৃত সত্য এক জিনিস নয়। জনগণ সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

ড. মাহবুব হাসান : কবি ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *