আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই দেশে বাড়াতে তোড়জোড় শুরু করে দেন ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে লোকসান দেখিয়ে নিজেরাই বাড়িয়ে দেন; কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে
দাম কমলে তখন আর দীর্ঘ সময়েও সমন্বয় করা হয় না। আলোচনা-সমালোচনার মুখে নানা কাঠ-খড় পুড়িয়ে কিছু কমানো হলেও
তা বাস্তবায়ন করতেই কেটে যায় আরও সময়। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা বাড়তি কামিয়ে ঠকান ভোক্তাদের।
আন্তর্জাতিক বাজারচিত্র বলছে, গত দুই মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পাম তেলের দাম কমেছে আরও বেশি; ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্ববাজারের এবারের এমন ধস ২০০৮ সালকেও ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের তথ্যে মিলেছে এ হিসাব। তাতে দেখা যায়, গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫০ ডলার। চলতি মাসের গত সপ্তাহে তা নেমে আসে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৮ ডলারে। এমন বড় দরপতন আগে কখনো দেখা যায়নি। অপরদিকে মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসের তথ্য বলছে, গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেলের দর ছিল ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। চলতি মাসের গত সপ্তাহে তা ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিতে নেমে আসে। এদিকে এত বড় দরপতনের পর দেশের বাজারে কেবল একবারই দাম কমানো হয়েছে, তা-ও মাত্র ৬ টাকা। গত ২৬ জুন লিটরে সামান্য এ টাকা দাম কমিয়ে দাম ধরা হয়েছে ১৯৯ টাকা। তবে রাজধানীর বাজার ও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মুদি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, দাম কমানোর ঘোষণার ২০ দিন পার হলেও বাজারে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বড় বাজারগুলোতে ১৯৮ থেকে ২০০ টাকা লিটারে বোতল পাওয়া গেলেও মহল্লার মুদি দোকানে এখনো আগের দাম ২০৫ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বিক্রেতারা বরাবরের মতোই দাঁড় করাচ্ছেন সেই অজুহাত- অনেকের কাছে আগের তেল রয়ে গেছে। তাই আগের বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন তারা।
মালিবাগ বাজারে সয়াবিন তেলের বোতল কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক বলেন, মহল্লার অন্তত চারটি দোকান ঘুরেও ১৯৯ টাকায় তেল কিনতে পারিনি। বলছে, পুরনো বোতল এখনো রয়ে গেছে। নতুন বোতল এলে দাম কমবে। শেষমেশ বাজারে এসে কমে কিনতে পেরেছি। দাম বাড়ার সময় একদিনেই বেড়ে যায়; কিন্ত কমার বেলায় লাগে অনেক দিন। এটাই যেন এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।
বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, আমদানি-মজুদ-সরবরাহের তথ্যে নজরদারির অভাব, মূল্য সমন্বয়ে বিলম্ব, নেই ত্বরিত সিদ্ধান্ত- এসব কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডির) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর বেলায় দ্রুততা দেখা যায়; কিন্তু দাম কমানোর ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে। ত্বরিত সিদ্ধান্তের নজির দেখা যয় না। ভোজ্যতেলের সঙ্গে কোটি কোটি ভোক্তাস্বার্থ জড়িত। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ দাম বাড়ে বা কমে দেশের বাজারে সে পরিমাণ বাড়ে-কমে না। এক্ষেত্রে সামাঞ্জস্য থাকতে হবে। কী পরিমাণ আমদানি হচ্ছে, কী পরিমাণ মজুদ ও সরবরাহ হচ্ছে সেদিকেও সরকারের কড়া নজরদারি থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তারকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ভোজ্যতেলের বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে। এখানে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন যে, এ খাতে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা রয়েছে কিনা। পাশাপাশি কোনো সিন্ডিকেট রয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে।
পণ্যের দাম বাড়ানোর বেলায় যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় দাম কমানোর বেলায় অনেক সময় একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না বলে মনে করেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি মো. গোলাম রহমান। গত ২৬ জুন সয়াবিনের দাম ৬ টাকা কমানো হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কতটা সামাঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আমাদের সময়কে গোলাম রহমান বলেন, আমি মনে করি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের উচিত একই পদ্ধতি ব্যবহার করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো ও কমানো। এক্ষেত্রে আমি মনে করি এই যে লিটারে ৬ টাকা দাম কমানো হলো তা যথাযথ নয়।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে অবশ্যই দাম বাড়াতে হবে। তেমনি দাম কমানোর বেলাতেও কালক্ষেপণ না করে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে দাম কমাতে হবে। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ওঠানামা করায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তার পরও সবকিছু বিবেচনায় রেখে নিয়মিত মূল্য সমন্বয় করতে হবে। কালক্ষেপণ করা যাবে না। দাম কমালেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। তা পুরোপুরি বাস্তবায়নও করতে হবে। নইলে ভোক্তারা ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা দেখি যে দাম কমানোর পরও নানা গড়িমসি করেন ব্যবসায়ীরা। এটাও কাম্য নয়। বাজার নজরদারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও তৎপর হতে হবে।
ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা হঠাৎ শুরু হয়নি। এর শুরুটা হয় ২০২০ সালের শেষ দিকে। করোনার প্রকোপে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশি নিত্যপণ্যের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক পণ্যবাজারে আরও উত্থান ঘটায়।
উল্লেখ্য, বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এ দুটি দেশ। সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় চাপ পড়ে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের ওপর। অন্যদিকে গত এপ্রিলের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ চাপ আরও রেড়ে যায়। এ ছাড়া আর্জেন্টিনাও রপ্তানি সীমিত করায় অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। তবে গত দুই মাসের ব্যবধানে বিশ^বাজারে সয়াবিন তেলের দামে বড় ধস নামায় রান্নার তেলের দামও কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের বাজারে এক দফায় লিটারপ্রতি ৬ টাকা কমলেও আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ কমেছে সে তুলনায় তা অনেক কম। শিগগিরিই দাম কমছে কিনা বা কবে কমবে সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে কবে নাগাদ দাম কমতে পারে কিংবা দাম কামানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে পরিষ্কার কোনো তথ্য জানাতে পারেননি ভোজ্যতেলের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দাম বাড়ানো হবে নাকি কমানো হবে সেটি ট্যারিফ কমিশনের কাজ, তাদের কাছেই জানা যাবে। এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না।
আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতনের পরও দেশে সয়াবিনের মূল্য সমন্বয়ে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছে বলে মনে করছেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকদের তেল দেশের বাজারে এলে দাম কমার কথা ছিল; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোনো সুফল পাননি।
তিনি আরও বলেন, ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উল্টো সুর- ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যসহ নানা ভৌতিক কারণে দাম আগের অবস্থানে ফিরছে না বলে দাবি করেন। যা ব্যবসায় সুশাসন, ব্যবসায়িক নীতি-নৈতিকতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
এর আগে গত ৯ জুন আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দামের কারণ দেখিয়ে সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে প্রতিলিটার ২০৫ টাকা নির্ধারণ করেন ব্যবসায়ীরা। গত মে মাসে যা ছিল ১৯৮ টাকা লিটার। রোজার আগে ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে দুই দফা মূল্য সংযোজন কর কমায় সরকার। মার্চে সয়াবিনের লিটার ছিল ১৬০ টাকা এবং গত ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ১৬৮ টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে এ দাম ছিল ১৬০ টাকা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫৩ এবং মে মাসে দাম ছিল ১৪১ টাকা।