জাতীয় বীর ও গৃহযুদ্ধের নায়ক যখন গণধিক্কৃত খলনায়ক

Slider টপ নিউজ


বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় জাতিভিত্তিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বহু পুরনো। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এর পর ২৬ বছরের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শেষে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল দেশটি। আর এই গৃহযুদ্ধ অবসানে ব্যাপক ভূমিকা রাখা দেশটির সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ছিলেন লংকান জনগণের জাতীয় বীর। কিন্তু ‘যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ’ প্রবাদের মতোই ক্ষমতা গোতাবায়াসহ রাজাপাকসে পরিবারকে এতটাই উন্মত্ত করে দিয়েছিল যে, সমৃদ্ধির স্বপ্ন ফিকে হয়ে যেতে সময় লাগেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের নিষ্ঠুর শোষণের উদাহরণ হয়েই এই পরিবার আবির্ভূত হয় একসময়। যার পরিণতি নজিরবিহীন আর্থিক সংকটে জেরবার আজকের দেউলিয়া শ্রীলংকা। ফলে একসময়কার জাতীয় বীর গোতাবায়ারও পতন ঘটেছে নজিরবিহীন সহিংস বিক্ষোভে। এখন তীব্র জনরোষের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর উপায় খুঁজছেন গণধিকৃত গোতাবায়া। কিন্তু কেন গোতাবায়াসহ শ্রীলংকার বিখ্যাত রাজাপাকসে পরিবারের আজকের এই পরিণতি, তা বিশ্লেষণ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলংকায় তামিল টাইগার বিপ্লবীদের পরাজিত করে প্রায় তিন দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো জাতীয় বীর গোতাবায়া রাজাপাকসের সেই সুসময় এখন অতীত। এক দশকের বেশি সময় শ্রীলংকা শাসন করেছে রাজাপাকসে পরিবার। কিন্তু তাদের শাসনকালেই ভুল সিদ্ধান্তের বলি হয়ে ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সেই দায় মাথায় নিয়ে প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রনেতাকে ক্ষমতা ছাড়তে হচ্ছে প্রবল গণবিক্ষোভের মধ্যে। এর আগে কয়েক মাস ধরে টানা বিক্ষোভের মধ্যে গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় গোতাবায়ার তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। কিন্তু তবু জনদাবি উপেক্ষা করে নিজের গদি আঁকড়ে ছিলেন গোতাবায়া। যার পরিণতি হয়েছে আরও ভয়াবহ।

প্রায় দুই দশক ধরে লংকান রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী- উভয় পদেই তিনি ছিলেন। সেই সময় লংকান রাজনীতিতে কেউ কেউ মাহিন্দাকে বলতেন সম্রাট। গোতাবায়া রাজনীতির দৃশ্যপটে এসেছিলেন বড় ভাইয়ের হাত ধরেই। ২১ বছর বয়সে গোতাবায়া শ্রীলংকান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দুই দশক সেখানে চাকরি করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন। সময়ের আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করেন। ২০০৫ সালে বড় ভাই মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হলে দেশের রাজনীতিতে গোতাবায় পদার্পণ ঘটে। সেই সময় তাকে দেওয়া হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব। স্বাধীনতাকামী তামিল টাইগারদের পরাজিত করে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোই ছিল তার মিশন। অবশেষে ২৬ বছর ধরে সংঘাতের পর ২০০৯ সালে সরকারের ভয়ানক আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তামিল টাইগারদের দল এলটিটিই। জাতিসংঘের ধারণা, যুদ্ধের শেষ কয়েক মাসে সরকারি বাহিনীর হাতে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক তামিল গণহত্যার শিকার হয়। যদিও শ্রীলংকা সরকার সেই সময় বলেছিল- বিদ্রোহীরা হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের কারণেই বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ওই সময় থেকেই সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা গোতাবায়াকে যুদ্ধের নায়ক হিসেবে দেখেন। তবে অনেকে আবার তাকে হত্যা, নির্যাতন এবং সরকারের সমালোচকদের গুম করাসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেন। অবশ্য সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোতাবায়া।

২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতা হারালে গোতাবায়াও পদত্যাগ করেন। কিন্তু ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে শ্রীলংকায় আত্মঘাতী বোমা হামলা ঘটলে রাজনীতির মাঠে ফেরেন চরমপন্থার বিরুদ্ধে কঠোর হিসাবে পরিচিত রাজাপাকসেরা। দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে না থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে মাহিন্দা সরে দাঁড়ালে রাজাপাকসের পরিবার ও শ্রীলংকার পডুজানা পার্টির পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন গোতাবায়া। ২০১৯ সালের নভেম্বরের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে বিপুল ব্যবধানে জয় পান গোতাবায়া। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে গোটা শ্রীলংকার প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০২০ সালের আগস্টে পার্লামেন্টে গোতাবায়ার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেড়ে দুই-তৃতীয়াংশে উন্নীত হয়। প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সীমাসহ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করার আইন বাতিলের অনুমতি মেলে। ওই সময়ই গোতাবায়া বড় ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরিয়ে আনেন এবং আত্মীয়দের মন্ত্রিপরিষদে জায়গা দেন। শুরু হয় রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবারতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করার মিশন। কিন্তু সাম্প্রতি করোনা মহামারীর প্রভাব এবং শুল্ক কমানোর মাসুল শ্রীলংকাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে হাজারও মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রান্নার তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের সংকটে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। এই দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের ওপর।

দেশকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলার জন্য গত এপ্রিলের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এবং তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ দেখা দেয়। যার পরিণতিতে মাহিন্দা পদত্যাগ করলেও গদি আঁকড়ে থাকা গোতাবায়া প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরিয়ে এনেছিলেন পুরনো মিত্র রনিল বিক্রমাসিংহেকে। কিন্তু রনিলও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত একসময়কার জাতীয় নায়ক গোতাবায়াকে বিদায় নিতে হলো খলনায়ক হিসেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *