দেশে দিন যত যাচ্ছে ফের করোনার আক্রান্ত ও মৃত্যু ততই বাড়ছে। সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে গত একদিনে আরও চারজন করোনা পজিটিভ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৭২৮ জন। এরই মধ্যে ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রনের দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা উপধরন শনাক্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন ঈদে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট ‘বিএ.৪’ এবং ‘বিএ.৫’ আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের দাবি সংক্রমণ রোধে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার ১০ হাজার ২৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৭২৮ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন প্রায় ১২ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৯৯৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। বুধবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়েছে। মঙ্গলবার তা ১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ ছিল।
নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে শনাক্ত মোট করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭০০ জন হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৯ হাজার ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২৬ জন রোগীর সেরে ওঠার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ১৯ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ জন।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর.বি) বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন-দেশে নতুন করে করোনা আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এ মহূর্তে বেশি সংক্রমণ ছাড়চ্ছে ওমিক্রন ধরন। এর জন্য দায়ী এই ভ্যারিয়েন্টের ‘বিএ.৪’ এবং ‘বিএ.৫’ নামক দুই সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা উপধরন। তবে সাব-ভ্যারিয়েন্ট উচ্চ সংক্রামক হলেও মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির হার কম। মঙ্গলবার আইসিডিডিআর.বি অফিসিয়াল সাইটে এ তথ্য আপলোড করা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিদ ও করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, গত বছর এই সময়ে বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছিল ডেল্টা ধরনের কারণে। এবার একই সময়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ ওমিক্রন ধরন। ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রন দুর্বল হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু ঝুঁকি কম হলেও বেশি সংক্রমণশীল।
এমন পরিস্থিতে আসন্ন ঈদে সাধারণ মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ওমিক্রনসহ নতুন ধরনটির সাব-ভ্যারিয়েন্ট সবখানে ছড়িয়ে পড়বে। কো-মরবিডিটিতে (বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত) ও বয়স্কদের মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হবে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ঈদে পশুর হাট, ঈদযাত্রা ও ঈদের জামাতে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর বিষয়ে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদকে ঘিরে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখনও যাদের টিকা নেওয়া বাকি আছে, তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উৎসব করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। এসব বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, দেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয় ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহে বেশিরভাগ করোনা পজিটিভ কেস ছিল ‘বিএ.১’। পরে জানুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সাব-ভ্যারিয়েন্ট ‘বিএ.২’ সংক্রমিত হয়। সময়ের ব্যবধানে ‘বিএ.১’ উপধরন রূপ পরিবর্তন করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটায়। এ অবস্থায় ১৯ মে ঢাকায় প্রথম সন্দেহভাজন ওমিক্রন সাব-ভ্যারিয়েন্ট ‘বিএ.৫’ রোগী শনাক্ত করা হয়। গত ছয় সপ্তাহে (১৪ মে থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত) ‘বিএ.৫’ সবচেয়ে প্রভাবশালী সাব-ভ্যারিয়েন্ট হয়ে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুস সবুর বলেন, প্রতিবারের মতো ঈদে ঘরমুখী মানুষের ঢল নেমেছে। পশুর হাট শপিংমল, গণপরিবহণ সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে ওমিক্রন সবখানেই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। কিন্তু অনেকে সংক্রামিত হলেও বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে ওমিক্রনের দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্টের উপধরন শনাক্ত হয়েছে। এরইমধ্যে কুরবানির ঈদ শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে বিপণিবিতানে ভিড় হচ্ছে। মানুষ গ্রামে যাচ্ছে। গণপরিবহণে চাপ বাড়ছে। এতে ঢাকায় সংক্রামিত ব্যক্তি গ্রামেও ছড়িয়ে দেবে। সামাজিক সংক্রমণ হবে। তাই করোনা রোধে সরকারি নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে। গণহারে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনা সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে এটা জানা কথা। তখন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাতে চাপ তৈরি হবে। এরই মধ্যে ঈদ উৎসব শুরু হয়েছে। এই উৎসবের কারণে সংক্রমণ আবার না বেড়ে যায় সবাইকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি রোগী শনাক্তে বেশি গুরত্ব দিচ্ছি। যাতে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাকে শনাক্ত ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারি। আমরা করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই। কিন্তু সবার আগে মানুষকেই এ কাজে সহায়তা করতে হবে।’