সবর বা ধৈর্যের আভিধানিক অর্থ- আনন্দ, প্রতিকূলতা, দুঃখ ও উদ্বেগের সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। সহ্য বা অপেক্ষা করার ক্ষমতা, সহিষ্ণুতা, ধীরতা। ধৈর্যের একটি অর্থ হচ্ছে তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার দ্রুত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া ও বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। ধৈর্যের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে-তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। দুঃখ-বেদনা, ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়াও ধৈর্যের একটি অর্থ। ধৈর্যের এক অর্থ হচ্ছে, সব রকম ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। সবরের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আলী রা: বলেন, সবর হলো এক ধরনের স্থিরতা, যা কখনো হোঁচট খায় না, কখনো বিচলিতও হয় না। আবু আলী দাক্কাক রহ. বলেন, সবরের প্রকৃতি এর নামের মধ্যেই লুকায়িত।
সবরের প্রথম অর্থ- তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার দ্রুত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া ও বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। এটি মুমিনের জন্য অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কাজের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কোনো ব্যক্তির দোয়া গৃহীত হয়; যতক্ষণ না সে তাড়াহুড়া করে; বলে, ‘আমার প্রভুর কাছে দোয়া তো করলাম, কিন্তু তিনি আমার দোয়া কবুল করলেন না।’ সুহাইব রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শোকরগুজার হয় আর অসচ্ছলতা বা দুঃখ-মুসিবতে আক্রান্ত হলে সবর করে। প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর।’
এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সূরা আত-তুরের ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তোমার রবের ফায়সালা আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করো। তুমি আমার চোখে চোখেই আছ। তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করো।’
সবরের দ্বিতীয় অর্থ-তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। দুঃখ-বেদনা, ভরাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া। আমরা কখনো কখনো সুখের উল্লাসে মেতে উঠি। আবার কখনো কখনো দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল বলেন, আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, বিপদের প্রথম অবস্থায়ই প্রকৃত সবর।’ অর্থাৎ, বিপদ-মুসিবত যা কিছুই আসুক না কেন, মুমিনের কাজ হবে সবর করা। সবরের মধ্যে প্রকৃত সফলতা নিহিত। আল্লাহ সবরকারীকে অনেক বেশি পছন্দ করেন এবং সবরকারীর জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন- আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-বাকারার ১৫৫ নং আয়াতে বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমি ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করব। এ অবস্থায় যারা সবর করে- তাদের সুসংবাদ দিয়ে দাও।’
ধৈর্যের তৃতীয় অর্থ- সব রকম ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা। মাঝে মধ্যে এমন হয় যে, আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি। এমনভাবে যে, আমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে-ইমরানের ১৮৬ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মুসলমানগণ!) তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক।’ আমাদের চেয়ে অন্যরা ভালো আছে। আমাদের দুঃখ কষ্টের শেষ নেই। আর ওরা আরামে স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। আমরা অভিযোগ করে বসি। আমরা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এটি উচিত নয়, মুমিনের জন্য। মুনাফিকরা খারাপ সময়ে যখন তারা বিপদে পড়ে যায়। তখন খুব বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে।
কিন্তু যখন বিপদ রক্ষা পায়, তখন সে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের অবস্থা হচ্ছে, যখন সে কোনো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়, তখন সে দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আমাকে ডাকে। কিন্তু যখন আমি তার বিপদ হটিয়ে দেই তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন সে কখনো নিজের কোনো খারাপ সময়ে আমাকে ডাকেইনি। ঠিক তেমনিভাবে সীমা অতিক্রমকারীদের জন্য তাদের কার্যক্রমকে সুশোভন করে দেয়া হয়েছে।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-১২)
ধৈর্যের আরেকটি অর্থ হচ্ছে বাধা-বিপত্তির বিরোচিত মোকাবেলা করা ও শান্তচিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করা। আল্লাহর রাসূলের একটি হাদিস আছে- কা’ব রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তির উদাহরণ হলো শস্যক্ষেতের নরম চারাগাছের মতো, যাকে বাতাস একবার কাত করে ফেলে, আরেকবার সোজা করে দেয়। আর মুনাফিকের দৃষ্টান্ত, ভূমির ওপর শক্তভাবে স্থাপিত বৃক্ষ, যাকে কিছুতেই নোয়ানো যায় না। শেষে এক ঝটকায় মূলসহ তা উপড়ে যায়।’
ধৈর্যের আরেক অর্থ হচ্ছে- শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। নসফের খায়েশ থেকে দূরে থাকাও একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তির অন্যতম গুণ। জুুননুন মিসরি রহ. বলেন, ‘সবর হলো আল্লাহ তায়ালার অপছন্দনীয় কাজ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, নীরবতা অবলম্বন করা, প্রচণ্ড বিপদ ও সঙ্কটেও নিজেকে সংযত রাখা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের কষাঘাত এলেও নিজের ব্যক্তিত্ব অক্ষুণœ রাখা’-এটাই হচ্ছে একজন সবরকারীর প্রকৃত গুণ। সে নফসের খায়েশ মেটাতে কখনো লালায়িত হয় না। সবসময় নফসের বিপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে।
সবর হলো- আল্লাহর পথে সবসময় অটল-অবিচল থাকা। সুখের সময় আর দুঃখের সময় দুই অবস্থায় স্থির হয়ে আল্লাহর পথে অবিচল থাকা। সবসময় আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর তাওয়াক্কুল রাখা। আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া। হজরত আইয়ুব আ:-এর রোগাক্রান্তের গল্প সবাই জানি। তার রোগ এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে একা রেখে পরিবার-পরিজন দূরে চলে গিয়েছিল। তিনি অধৈর্য হয়ে যাননি। তিনি আল্লাহর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন খুব চমৎকার ভাষায়। ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ দয়াবান।’ (সূরা আম্বিয়া-৮৩) আল্লাহ তার প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি তাকে পেলাম সবরকারী। চমৎকার বান্দা তিনি! নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন আমার অভিমুখী।’ (সূরা সোয়াদ-৪৪) ইয়াকুব আ: সন্তান হারিয়ে অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি সেই দুঃখ কষ্ট আল্লাহর কাছে পেশ করেছিলেন- ‘আমি আমার দুঃখ ও অস্থিরতা একমাত্র আল্লাহর কাছেই নিবেদন করছি।’ (সূরা ইউসুফ-৮৬) আল্লাহর রাসূলের আরেক সাহাবি- যার চক্ষুরোগ হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে জায়েদ ইবনে আকরাম, তোমার চক্ষুরোগ যদি আর না সারে। তাহলে তুমি কী করবে?’ তখন তিনি বললেন, আমি সবর করব। এটাই হলো মুমিনের গুণ।
আমাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, সুখ-শান্তি, যা কিছু আসে সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আমরা অসুস্থ হই, আমরা আবার সুস্থ হই। আমরা অভাবগ্রস্ত হই আবার সচ্ছল হই। এগুলো সবই আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বেশি পরীক্ষা করেন। মুমিনরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।
লেখক :ইমরান উদ্দিন. শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়