বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) পাঁচ সদস্য জমির দাম বেশি দেখাতে একটি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে ১০৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি টাকা ঘুষ নেন ট্রাস্টি বেনজীর আহমেদ। তিনি নেন ৩৮ কোটি টাকা। তার পরই রয়েছেন এমএ হাশেম; তাকে দিতে হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। বাকিরা ঘুষ নেন ৯ কোটি থেকে ১৪ কোটি টাকা পর্যন্ত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের অনুসন্ধান বলছে, শুধু ঘুষ নিয়েই তারা ক্ষান্ত হননি। ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়, টিউশন ফির টাকায় গাড়ি কেনা এবং নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ জমা রাখার মতো অনেক অনিয়ম-দুর্নীতিও করেছেন তারা। দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির তহবিল থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে জমি কেনা হয়। অথচ ওই জমি কেনার ব্যাপারে বিওটির সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। এ নিয়ে বিওটির ওই সময়ের সদস্য ড. রওশন আলম আদালতে মামলা করেন। এ ছাড়া জমি ক্রয়ে অনিয়ম তুলে ধরে ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিতে অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যকে না জানিয়েই সভায় ৫০০ কোটি টাকায় জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর অভিযোগ দুদকের হাতে এসে পৌঁছায়। জানা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি অনুসন্ধান শেষে চলতি বছরের ৫ মে মামলা করে দুদক।
মামলায় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফরিদউদ্দিন পাটোয়ারীর দায়েরকৃত মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হলো বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকেলস (রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস) অনুযায়ী ওই বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনকে পাশ কাটিয়ে বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের কয়েকজন সদস্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ডেভেলপমেন্টের নামে ৯ হাজার ৯৭ ডেসিমাল জমির ক্রয়মূল্য বাবদ ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা বেশি দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশে কম দামে জমি ক্রয় সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন। পরে বিক্রেতার কাছ থেকে কমিশন বা ঘুষ হিসেবে চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন এবং নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন। এর পর ওই এফডিআরের অর্থ মেয়াদপূর্তির আগেই উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
মামলা দায়ের করার পর এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান বলেছেন, নর্থ সাউথের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যে আমাদের অনুসন্ধানে জমি কেনার নামে প্রায় ৩০৩ টাকা ৮২ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের সত্যতা পাওয়ায় মামলা হয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যলয়ের জন্য জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে কারা জমি ক্রয়ের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন, কারা ঘুষ নিয়েছেন, তার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উন্নয়নে আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের কাছ থেকে ৯ হাজার ৯৬ ডেসিমেল জমি ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ জমি কিনতে গিয়ে নর্থ সাউথের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন আশালয় হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালীর কাছ থেকে ১০৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন।
বেনজীর আহমেদ নেন ৩৮ কোটি টাকা : ট্রাস্টি সদস্য বেনজীর আহমেদকে আশালয় হাউজিংয়ের এমডি আমিন মো. হিলালীর ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বনানী অ্যাকাউন্ট থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পাঁচটি চেকের ৯ কোটি, আগস্ট মাসে ১১ কোটি, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তিন কোটি এবং মে মাসে পাঁচ কোটিসহ মোট ৩৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এসব টাকা তিনি এফডিআর করে রাখেন এবং এফডিআর মেয়াদ পূর্তির আগেই ভেঙে টাকা সরিয়ে ফেলেন।
এমএ কাসেম নেন ৯ কোটি টাকা : ২০১৬ সালের ৯ মে আশালয় হাউজিংয়ের এমডি আমিন মো. হিলালীর ইউসিবি ব্যাংকের করপোরেট শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রাস্টি সদস্য এমএ কাসেমকে পাঁচ কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়। এর পর একই বছরের ২৫ জুলাই আশালয় হাউজিংয়ের এমডির ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বনানী অ্যাকাউন্ট থেকে আরও চার কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচ কোটি টাকার চেক এমএ কাসেমের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এয়ারপোর্ট রোড শাখার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। আর চার কোটি টাকা ডাচ্্ বাংলা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে তিনি উত্তোলন করেন।
রেহানা রহমান নেন ১৪ কোটি টাকা : ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই আশালয় হাউজিংয়ের এমডি আমিন মো. হিলালীর ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রাস্টি সদস্য রেহানা রহমানকে ছয় কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়। এর পর একই বছরের ৫ আগস্ট আশালয় হাউজিংয়ের এমডির ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে আরও আট কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়।
দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আশালয় হাউজিংয়ের এমডি আমিন মো. হিলালীর এমডির ব্যাংক হিসাব থেকে নর্থ সাউথের ট্রাস্টি এমএ হাসেমের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি টাকা পাঠানো হয়। দুদকের অনুসন্ধানকালে তিনি মারা যাওয়ায় তাকে মামলার আসামি করা হয়নি। দুদকের পরিচালক আরও বলেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জমি ক্রয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। কম মূল্যের জমি বেশি কিনতে গিয়ে যে কয়েকজন ট্রাস্টি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নেন, তাদের আসামি করা হয়েছে। এখন তদন্ত চলছে। তদন্তে অন্য কারও ঘুষ গ্রহণসহ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেলে তাদের চার্জশিটে আসামি করা হবে।
এদিকে জমি কেনার নামে ৩০৩ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ট্রাস্টি এমএ কাসেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান কারাগারে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। অপর আসামি এম হাশেম মারা গেছেন। মামলার অপর আসামি আজিম উদ্দিন আহমেদ ও আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালীর ফোনে বারবার যোগাযোগ করে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।