কেউ যখন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে যেন স্মৃতিভ্রম পেয়ে বসে। তিনি তখন এমনভাবে কথা বলেন, যেন কোনোকিছু আর সঠিকভাবে মনে করতে পারছেন না। সত্যিকার জবাব দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই ঘটেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি এখন তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন।
১৬ জুন এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চুক্তি বাতিলে ড. ইউনূসের হাত আছে। তার বন্ধু সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে তদবির করে তিনি এ অর্থায়ন বন্ধ করেন।
এরপর ইউনূস সেন্টারের এক বিবৃতিতে নিজের দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অভিযোগ অস্বীকার করেন ড. ইউনূস। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পদ্মা সেতুর জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনের পর যাবতীয় প্রশ্ন ও কঠিন বাস্তবতাকে ইচ্ছাকৃত পাশ কাটিয়ে গেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের এ প্রতিষ্ঠাতা।
বিবৃতিতে নিজেকে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন ড. ইউনূস। ঐতিহাসিক এ অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনও জানান তিনি।
বুধবার (২৯ জুন) রাতে ‘অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব’ শিরোনামে বিবৃতি প্রকাশ করে ইউনূস সেন্টার। এতে পদ্মা সেতুর বিরোধিতা কিংবা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেন এ অর্থনীতিবিদ।
ফ্যাক্টচেক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে ড. ইউনূসের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন, তখন বেশ অসংগতিপূর্ণ জবাব দেন ড. ইউনূস।
এক দশক আগে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন সুশীল সমাজের কয়েকজন সদস্য, পত্রিকার সম্পাদক ও ড. ইউনূস।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তখনকার কমিশনার শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ২০১১ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় দফায় ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্ধারিত বৈঠকের আগে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে তারা ভোজসভায় অংশ নেন।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করেছিল দুদক। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে যখন উত্তেজনা চরমে, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সমস্যা (এমডি পদ) মিটিয়ে ফেলতে পরামর্শ দেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা। মাহফুজ আনামসহ দুটি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ড. কামাল হোসেনের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বৈঠকে ছিলেন।
চুপ্পু বলেন, বৈঠকে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে নেতিবাচক মন্তব্য করেন তারা। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে বৈঠক নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কঠিন জগৎ দুই বন্ধুর খেয়াল-খুশি বা একজন পত্রিকা সম্পাদকের সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু বৈঠকে অংশ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকারও করেননি তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিবৃতিতে ড. ইউনূস দাবি করেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বহাল থাকতে তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেননি। বরং ব্যাংকটির মৌলিক আইনি মর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছেন তিনি। তখন তিনি ৬০ বছর অতিক্রম করার পরও সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে পদটি দখল করে রেখেছিলেন। এরপর এমডি পদ হারালে তিনি হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করেন।
অস্বাভাবিক সুদহারের, ২০ থেকে ২৬ শতাংশ, জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সবসময় সমালোচিত ছিল। এতে গরিব মানুষ আরও বেশি গরিব হয়ে যেত। কিস্তি শোধ করতে গিয়ে তাদের ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হতো। গ্রামীণ ব্যাংকের স্বপদে বহাল থাকতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগও অস্বীকার করেন ইউনূস।
নিজের আয়ের উৎস হিসেবে বক্তৃতা বাবদ ফি এবং ২৫টি ভাষায় প্রকাশিত তার বইয়ের সম্মানির কথা উল্লেখ করেন তিনি। এসব অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখেছেন। সেখান থেকেও তার একটা বড় আয় আসে বলে দাবি করেন ড. ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে বেতনের বাইরে কোনো অর্থ কিংবা গ্রামীণফোনের শেয়ারের মালিকানাও নেননি বলে দাবি করেন তিনি।
ইকবাল কাদির
বিবৃতিতে গ্রামীণফোনের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল জে. কাদিরের নাম উল্লেখ করেনি ইউনূস সেন্টার। ১৯৯৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য একটি ফোন চালু করতে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে যান ইকবাল কাদির। তার দেয়া আইডিয়া গ্রহণ করে গণফোন চালু করে গ্রামীণ ব্যাংক। এর মধ্য দিয়ে সেলফোন জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে ব্যাংকটি। পরে গণফোনই গ্রামীণফোন নামে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসা এ ব্যক্তিকে স্বীকৃতি না দিয়ে ড. ইউনূস মারাত্মক সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন।
ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে অনুদান
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে কোনো অনুদান দেননি অধ্যাপক ইউনূস। এ অভিযোগকে কল্পনাপ্রসূত ও মানহানিকর বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সব ধরনের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করেছে সরকার।
২০১৬ সালের আগস্টে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রকাশ করা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুসারে, গ্রামীণ ব্যাংকের অলাভজনক দাতব্য শাখা গ্রামীণ আমেরিকা, যার প্রধান ড. ইউনূস, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে এক থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ রিসার্চ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান (এটিরও চেয়ারম্যান ড. ইউনূস) থেকেও ২৫ থেকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দেয়া হয়।
উইকিলিকস
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেন ড. ইউনূস। কিন্তু উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্য নিয়ে ইউনূস সেন্টার কিছু বলেনি, যা নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে খবর প্রকাশ করা হয়েছে।
উইকিলিকসের তথ্যানুসারে, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থসহায়তা বন্ধে ড. ইউনূস স্পষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মধ্যকার ই-মেইলের উদ্ধৃতিও উইকিলিকসের তথ্যে আছে।
কেবল একটি পদের লোভে
২০১১ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় মানববন্ধনের আয়োজন করে একটি ফেসবুক গ্রুপ। এতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
অনেকের দাবি, ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি ড. ইউনূসের মাথা থেকে প্রথম আসেনি। তাদের যুক্তি, ১৯৮০-র দশকে ড. ইউনূস যখন এই চিন্তাধারা নিয়ে এগোচ্ছেন, তারও বহু আগে এটি বিদ্যমান ছিল।
রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ভুল
রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে অপচেষ্টা এবং নেপথ্য ভূমিকার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হন অধ্যাপক ইউনূস। বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৭ সালে ড. ইউনূসকে তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিকতার অবসান ঘটাতে বলা হয়।
তখন খায়েশ পূরণে নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন অধ্যাপক ইউনূস। তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সফল করতে আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যারি রবিনসন, হিলারি ক্লিনটন, জন কেরি ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকেও ব্যবহার করেন তিনি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মতো নেতাদের হাত থেকে ‘বাংলাদেশকে উদ্ধারে’ তারা প্রকাশ্যে ইউনূসকে সমর্থন দেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হিলারি ক্লিনটনের মাধ্যমে ড. ইউনূস ভারতের কাছে একটি আবেগঘন আবেদন করেন। তাতে শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ করে দিতে ড. ইউনূসের উদ্যোগে ভারতকে সমর্থন দিতে অনুরোধ করা হয়।
সে সময় ড. ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে বড় ধরনের ভুল হিসেবে আখ্যায়িত করেন তার সমর্থকরা। পরে দ্রুতই সে পদক্ষেপ থেকে সরে আসেন তিনি।