গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অপরিহার্য অধিকারগুলোর অন্যতম হলো বাকস্বাধীনতা। মানুষ ভাববে, কথা বলবে, অন্যের কথা জানবে অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মতামত জানার স্বাধীনতা আমাদের দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত। তা সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ সংশোধনী ধারায় এই অধিকার কেড়ে নেয়া হয় ২০০৯-এ। সংশোধিত ধারা অনুযায়ী তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় যে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আছে, তাতে যদি কেউ অত্যন্ত আক্রমণাত্মক, কদর্য, আপত্তিজনক, অসুবিধাজনক, বিপজ্জনক কিংবা অপমানজনক কোন তথ্য, বিবৃতি ও ছবি দেয়, তাহলে এই অপরাধের জন্য পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। অপরাধ সাব্যস্ত হলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদ- ও অর্থদ-। এই ধারাটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দেশের শাসক শ্রেণী এর অপব্যবহার করেছে ষোল আনার ওপর আঠারো আনা। রাজনৈতিক দলগুলো এই দমনমূলক ধারাটি নিয়ে বিগত ছ’বছর টুঁ-শব্দটি করেনি। বরং তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কেউ কোন সমালোচনাযোগ্য বিষয় নিয়ে মুখ খুললে, মন্তব্য করলে কিংবা চিত্র-ব্যঙ্গচিত্র অন্য কাউকে পাঠালে, রাজনীতির দাদা-দিদিরা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছেন। ফল গ্রেপ্তার ও কারাবাস। কণ্ঠরোধ করার এই বেআইন নিয়ে জনগণও সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করেনি। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত আইনের এক ছাত্রী ৬৬এ ধারার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। অতি সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন। তাদের রায়ে বিচারপতিরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারাটি অসাংবিধানিক, বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি, অস্বচ্ছ ও পরিণামে ভয়ঙ্কর। এই ধারা জনগণের মৌলিক অধিকারের ওপর বিরাট আঘাত। কেন অস্পষ্ট, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শীর্ষ আদালত বলেছে, ইন্টারনেটে বা ওয়েবসাইটে কী ধরনের কার্যকলাপ ‘আপত্তিজনক’, ‘অসুবিধাজনক’ ইত্যাদি তার কোন সংস্থা নেই। ফলে প্রশাসন কোন নিরিখে ঠিক করবে কোনগুলো অপরাধ, কোনগুলো নয়? সবদিক বিবেচনা করে বিচারপতিরা মন্তব্য করেছেন, ৬৬এ ধারাটি বাতিল করতে আমরা কুণ্ঠিত নই। আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে আদালতই গণতন্ত্রের প্রহরী, মানুষের শেষ ভরসাস্থল। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ক্ষেত্রেও উচ্চতম আদালত আবার সেই ভূমিকা পালন করলো। জনগণতন্ত্রের এই জয়ে সারা দেশের সংবেদনশীল মানুষ খুশি। মতপ্রকাশের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পশ্চিমবঙ্গে এই আইনের চূড়ান্ত অপপ্রয়োগ হয়েছে। এবার এখানকার শাসকরা কী করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। এদিকে, ধারাটি খারিজ করে দিলেও, সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়েছে, ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘœ ঘটালে কেউ পার পাবে না। ভারতীয় দ-বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বাধীনতা বা অধিকার মানে যে আইনকানুন চৌপাট করে দেয়া নয়, এই দিকটিও মনে রাখা নাগরিকদের কর্তব্য।