বেশিদিনের কথা নয়, ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট এক বৃষ্টিভেজা দিনে বৃষ্টির পানিতে চোখের জল লুকাতে লুকাতে কথাগুলো বলেছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়া, মর্যাদার সঙ্গে আত্মসম্মান নিয়ে চলাফেরার পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। শোর উঠেছে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা নিয়ে, পিটিয়ে মেরে ফেলা নিয়ে। শিক্ষক কেন- যে কোনো মানুষকে কি আপনি কান ধরে ওঠবোস করানো, অপমান করা, ঘুষি মারা, লাথি মারা, পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা বা মেরে ফেলার মতো নোংরা ও জঘন্য কাজকে অনুমোদন করবেন? মুখে যায় বলি না কেন, এগুলো আমরা অনুমোদন করি। না হলে রাস্তাঘাটে রিকশাচালক, নানা পেশার মানুষের গায়ে হাত তোলা- এত ঘটনা রোজদিন ঘটত না। রীতিমতো জোটবদ্ধ হয়ে বা ‘চাঁদা তুলে’ এসব সহিংসতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, মেনে নিচ্ছি। ফার্মগেটে বাসে আমার পাশেই বসেছিলেন চুপচাপ এক আপাত নিরীহ হালকা-পাতলা গড়নের এক যাত্রী। হঠাৎ ফুটপাথে হইচই। কন্ডাক্টর জানান- পকেটমার ধরা পড়েছে, সামনের বাসে তাকে সাইজ করা হচ্ছে। নিমেষে বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেলেন আমার সেই সহযাত্রী। অনেকেই নামলেন ‘হাতের সুখ’ মেটানোর জন্য, কথিত পকেটমারকে দুঘা দিয়ে দুনিয়া আর আখেরাতের অশেষ সওয়াব হাসিল করার নেশায়। কেউ প্রশ্ন করেনি- যাকে পেটানো হচ্ছে, তিনি কি আসলেই কারও পকেট কেটেছেন? কেটে থাকলে প্রমাণসহ পুলিশের হাওলা কেন করা হচ্ছে না? ‘পুলিশকে দিলে এখনই ছেড়ে দেবে, ওরা ওদের পার্টনার’ বললেন একজন। তাই পিটিয়ে নগদ শিক্ষা দিতে হবে তাকে। এতে মানুষটির প্রাণ গেলে যাবে। সহিংসতার প্রতি এই আমাদের মনোভাব।
‘হাতটা ভেঙে পেটের মধ্যে ঢুকায়ে দেব, এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফ্যালায়ে দেব, চোখ তুলে নেব, মেরে কান ফাটিয়ে দেব’ ইত্যাদি আমাদের নিত্যদিনের বুলি ও সমাজ অনুমদিত বচন। এমন কোনো টিভি নাটক, সিনেমা আছে- যেখানে চড়-থাপ্পড়, মারধর নেই। স্বাস্থ্য সংক্রমিত হয় না। সেটির চর্চা করতে হয়। অন্যদিকে রোগ ছড়ায় বাতাসের বেগে। সহিংসতা তেমনি একটি রোগ। দ্রুত ছড়ায়। একই সঙ্গে আমরা এর চর্চা, পরিচর্চাও করি। তাই এখন আর কাউকে পরোয়া করছি না। শিক্ষক, মা-বাবা, বয়স্ক, শিশু- কেউ কোনো ছাড় পাচ্ছেন না। নানা কারণে ও বিবেচনায় ‘সবলরা’ যখন-তখন দুর্বলদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে- ক্ষুধার্ত বন্যপ্রাণী যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের ওপর। বন্যপ্রাণীরও একটি বিবেচনা আছে। ক্ষুধা মিটে গেলে সেটি আর ঝাঁপায় না। কিন্তু আমাদের ক্ষুধা মেটে না।
ফিরে যাই ২০১৫ সালের ৩০ আগস্টে। আমাদের গোল্ড ফিশের স্মৃতি। তবুও কারও কারও নিশ্চয় মনে করতে অসুবিধা হবে না সেদিনের ঘটনা। ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদনও করে কোনো কোনো টিভি চ্যানেল। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বঘোষিত একাডেমিক কাউন্সিল ঠেকাতে সকাল ৯টা থেকেই প্রশাসনিক ভবন-২ (উপাচার্য ভবন)-এর সামনে অবস্থান কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারী ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ’ শিক্ষক পরিষদের। অন্যদিকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি ঠেকাতে সকাল ৭টা থেকে সেখানেই অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পরে সকাল সাড়ে ৭টায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপস্থিত হলে কতিপয় ছাত্র তাদের বাধা দেয়। শিক্ষকদের সঙ্গে বাধা প্রদানকারী ছাত্রদের তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ সময় ছাত্র নেতাকর্মীরা ‘শাবিপ্রবির মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলাও চালায়। ছিনিয়ে নেয় শিক্ষকদের ব্যানার। লাঞ্ছিত হন শিক্ষক ড. ইয়াসমীন হক। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এক ছাত্রলীগ কর্মীকে এ সময় এক শিক্ষকদের লাথি মারতেও দেখা যায়। ঘটনার মাত্র হাত দশেক দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচক্করে তখন একাকী বসে ছিলেন জাফর ইকবাল। তিনি তখনো কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক। পরে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজ যা দেখলাম, আমার জীবনে এ ধরনের ঘটনা দেখব তা আমি কখনো কল্পনা করিনি। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই স্লোগান দিতে দিতে শিক্ষকদের মারপিট!!! স্লোগানটির এতবড় অপমান আমি আমার জীবনে দেখিনি। এখানে যে ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত।’ শিক্ষকদের লাঞ্ছনায় নিশ্চয় তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু তার কষ্টটা বেড়ে গেছে স্লোগানের অপব্যবহারে। তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিতে চেয়েছিলেন- যদি ছাত্ররা তার বিভাগের হয়। অন্য বিভাগের হলে কি তার কোনো আপত্তি নেই? শিক্ষকদের লাঞ্ছনার শাস্তি বা অপরাধীর অপরাধের গভীরতা পরিমাপ করার সময় তার মুখের ভাষা আর বিভাগের কথা আমলে নেওয়ার মধ্যে নিন্দুকদের অনেকে নিশ্চয় কোনো বদ গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করবেন। এই তর্ক এখন থাক।
দূরদেশ কানাডায় বসে টিভিতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার দৃশ্য দেখে একজন খোলা চিঠি লিখেছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবালকে- ‘আপনার কোনো বই আমি পড়িনি। চিঠিটি লিখতে আমি লজ্জা পাচ্ছি এই ভেবে- একটু অপরাধ বোধ হচ্ছে আমার। তবে সবচেয়ে বেশি লজ্জা লাগছে আমার পনেরো বছরের মেয়ের কাছে যখন ব্যাখ্যা করছিলাম আমার প্রিয় মাতৃভূমির ছাত্ররা কেন তার শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে- তখন তার চেহারায় বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য, বিস্ময়, অবহেলা ও কিছুটা ঘৃণা সৃষ্টি হলো; সেটিই আমাকে লজ্জা দিচ্ছে ভীষণ। বিদেশে বসে আমরা বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোই খুলে রাখি। দেশটি দেখি টিভির জানালায়। হঠাৎ দেখি কতকগুলো উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র শিক্ষকদের ঘিরে ধরে ধস্তাধস্তি করছে। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার দৃশ্য দেখে আমি সহ্য করতে পারলাম না। চিৎকার করে আমার স্বামীকে ডাকতে লাগলাম। আমার মেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে- কী মা, কী হয়েছে? তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। আমার তখন হুঁশ ছিল না। আমি কাঁদতে কাঁদতে আঙুল তুলে টিভির দিকে তাকাতে বলে বললাম- দেখ, ওই ছেলেরা ওদের শিক্ষকদের মারছে। মেয়ে অবাক হয়ে টিভির কাছে গেল। মিনিট কয়েক পর টিভিটা বন্ধ করে আমার পাশে এসে বসল।’
শিক্ষকদের গায়ে কি শুধু ছাত্ররা হাত তুলছে? ২০২১ সালের অক্টোবর বগুড়ার এক বিদ্যালয়ের সভাপতি প্রধান শিক্ষকের মুখে ঘুষি মেরে তার তিনটি দাঁত ফেলে দিয়েছিলেন। লেখালেখি হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি। ওই যে, জাফর ইকবাল খুঁজেছিলেন লাঞ্ছনাকারীদের পরিচয়! এখানেও হয়তো সেটিই প্রাধান্য পেয়েছিল। দিনে দিনে বিদ্যালয় পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটির খবরদারি যে অসহনীয়ভাবে বেড়েই চলেছে, সেটি নিয়ে কেউ কথা বলেনি।
২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বলাখাল জেএন উচ্চবিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্কুলের ভূমি দখলের প্রতিবাদে মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল। সেখানে ভূমিদস্যুদের পক্ষ থেকে গু-ারা এসে এক শিক্ষকের গায়ে হাত তোলে। তাকে উত্তমমধ্যম দিয়ে মানববন্ধন ভ-লের চেষ্টা চলে। ছাত্ররা ক্ষেপে যায়। মহাসড়ক অবরোধ করে। আশ্বাসের ঝুড়ি নিয়ে প্রশাসন ছুটে আসে। ন্যায়বিচার হয়নি। হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যায় সবকিছু।
এ বছরের এপ্রিলে কুষ্টিয়া শহরের লাহিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলামকে এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তার ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের দিয়ে বেধড়ক মারধর করিয়াছেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দিন চলে ঠিকাদারির বখরায়। একটি সড়কের মেরামত কাজের জন্য স্কুলের পানি-বিদ্যুৎ ব্যবহারসহ খেলার মাঠে ইট-বালু ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী রাখতে চেয়েছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। প্রধান শিক্ষক রাজি হননি। তাই একদল দুর্বৃত্তসহ প্রধান শিক্ষকের অফিস রুমে ঢুকে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। দুর্বৃত্তরা শিক্ষককে মারধর করা ছাড়াও তার অফিসের ফাইলপত্র তছনছ করে, ভাঙচুর করে আসবাবপত্র। একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এভাবে স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষকের ওপর চড়াও হতে বা হামলা চালাতে পারেন কি?
ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজে ফরম পূরণের টাকা কমানোর নামে শিক্ষকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, মারধর, লাঞ্ছনা ও কটূক্তি এবং সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের প্রতিবাদে বিচার দাবিতে সারাদেশে কর্মবিরতি ও মানববন্ধন করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। আপামর শ্রেণিপেশার মানুষের দ্বারা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা বুঝে গেছে, তাদের মারলে-ধরলে কেউ কিছু বলবে না। পথের রিকশাচালকের মতো তারাও দুর্বল। সব দুর্বল মার খাবে আর শিক্ষকরা ছাড় পাবেন- এটা কি একটু বেশি আকাক্সক্ষা নয়? তাই ¯েœহের ছাত্ররাও আর বসে নেই।
শরীয়তপুর কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষাকেন্দ্রের পরিদর্শক হিসেবে অন্য কলেজের কয়েক শিক্ষক সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। মৌখিক পরীক্ষা শেষে বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে খাবারের আয়োজন করা হয়। কলেজের এক ছাত্রনেতা ২০-২৫ কর্মী নিয়ে সেখানে গিয়ে এই বলে চড়াও হয়- ‘খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানে তাদের কেন দাওয়াত দেওয়া হয়নি? এ নিয়ে বাকবিত-ার একপর্যায়ে এক শিক্ষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারে তাদেরই স্নেহের ছাত্ররা।
সাভার ও নড়াইলের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়, এটি আমাদের অধঃপতনের ধারাবাহিকতা। যে কারও গায়ে হাত তোলা এবং তাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা একটি গর্হিত এবং ক্ষমার অযোগ্য কাজ, সেটি আমাদের জোরেশোরে বলতে হবে। আর শিক্ষকদের ওপর এ রকম আচরণ দিন দিন বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে, সহিংসতার সব আগল খুলে গেছে। যে সমাজে নিত্য শিক্ষকদের অবহেলা ও অপমান করা হয়, বুঝতে হবে ওই সমাজের শেষ বাতিটা নিভে যাচ্ছে। এখনই সাবধান না হলে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তখন সত্যি সত্যিই আমাদের দড়ি খুঁজতে হবে বাঁধার জন্য বা গলায় দেওয়ার জন্য।
গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক