পদ্মা সেতুর রেলিং থেকে নাট-বল্টু খুলে সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত পটুয়াখালীর বায়েজিদ তালহা মৃধা। ইতোমধ্যে তাকে সিআইডি পুলিশ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে পাঠিয়েছে। তবে বায়েজিদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চলছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
বায়েজিদের গত দিনের রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে তোলা কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাসছে। যেখানে দেখা যায় তিনি ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবিও ভাইরাল হয়েছে।
তবে আলোচনার তুঙ্গে থাকা বায়েজিদের দায়দায়িত্ব নিতে চাইছে না কোনো দলই। উল্টো এক দল অন্য দলের কর্মী হিসেবে গছিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। এ নিয়ে পটুয়াখালীসহ জনমনে একটাই প্রশ্ন, বায়েজিদ তাহলে কোন দলের অনুসারী— ছাত্রদল নাকি ছাত্রলীগ?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামের নির্মাণশ্রমিক মো. আলাউদ্দিন মৃধার ছোট ছেলে মো. বায়েজিদ তালহা মৃধা। বায়েজিদ স্থানীয় গাবুয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিরত আছেন।
তবে বায়েজিদ ঢাকায় থাকায় স্থানীয়ভাবে তেমন পরিচিত নন। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে গ্রামের বাড়ি এলেও দু-এক দিন থেকে আবার ঢাকায় ফিরে যেতেন।
গত রোববার পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরদিন রেলিং থেকে নাট-বল্টু খুলে একটি ভিডিও তার নিজস্ব টিকটক আইডিতে ছাড়েন বায়েজিদ। মুহূর্তেই সেটি ভাইরাল হয়। এতে শুরু হয় নানা ধরনের সমালোচনা। পরে সিআইডি পুলিশ ঢাকার শান্তিনগর থেকে বায়েজিদকে গ্রেপ্তার করে।
এরপরই কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বায়েজিদ একসময় ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বায়েজিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় বিএনপি এবং ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে ছবি ভাইরাল হয়, যা নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর সঙ্গে একটি বাসভবনে সেলফি তুলছেন। অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা যায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকসুর সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে বায়েজিদ। এদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের পটুয়াখালী পিডিএস মাঠ-সংলগ্ন বাসার সামনে একটি সাইনবোর্ডের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি।
এ ছাড়া অন্য কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে একটি সমাবেশে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ইশরাক হোসেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেলফি তুলছেন বায়েজিদ। অপর দুটি ছবিতে দেখা যায় বায়েজিদ পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী আশফাকুর রহমান বিপ্লবের সঙ্গে। একটি ছবিতে গলায় হাত দিয়ে সেলফি তুলছেন। আরেকটিতে একই আইডি কার্ডের ফ্রেম গলায় ঝুলিয়ে আছেন।
এদিকে বায়েজিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এবং বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে ছবি থাকলেও, দল দুটির নেতারা একে অন্যের ওপর তাদের কর্মী হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, বায়েজিদ ছাত্রলীগের সাবেক সক্রিয় কর্মী আবার কেউ বলছেন, ছাত্রদলের সাবেক সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
স্থানীয় অনেকে বলছেন, বায়েজিদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো ছবিতে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে বায়েজিদ কোন দলের অনুসারী?
পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী আশফাকুর রহমান বিপ্লব বলেন, বায়েজিদ ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। বায়েজিদ এসএসসি পরিক্ষা দিয়েই ঢাকা কলেজে পড়েছে। সে ওখানেই ছাত্রলীগ করত। ছাত্রদল করার প্রশ্নই আসে না বরং এখন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছবি ভাইরাল হচ্ছে।
আপনার সঙ্গে ছবি ভাইরাল হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বায়েজিদ আমার এলাকার ছোট ভাই। ছবি থাকতেই পারে। তবে রাজনৈতিক কোনো ছবি নেই। রাজনৈতিকভাবে সম্পর্কও নেই তার সঙ্গে।
পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আল হেলাল নয়ন বলেন, বায়েজিদ নামের কাউকে আমরা চিনি না। আর আমাদের সঙ্গে ছাত্রদলও করত না।
অন্যদিকে পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি হাসান শিকদার বলেন, বায়েজিদ কখনো আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ করেনি। কোনো মিছিল-মিটিংয়েও দেখি নাই। বরং সে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বিপ্লব গাজীর সঙ্গে ছাত্রদল করত। তাকে ছাত্রদলের মিছিল-মিটিংয়েও দেখেছি। ফেসবুকে দেখলাম বিপ্লব গাজীর সঙ্গে বায়েজিদের ঘনিষ্ঠতার ছবি ভাইরাল হয়েছে।
যা বলছে বায়েজিদের পরিবার
এদিকে বায়েজিদ পদ্মা সেতুর রেলিং থেকে নাট-বল্টু খোলায় অনুতপ্ত পরিবার ও স্থানীয়রা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
বায়েজিদের মেজ ভাবি হাদিসা আক্তার ও ছোট চাচি ফরিদা বেগম বলেন, বায়েজিদ মানুষ হিসেবে ভালো। ও বাড়িতে আসলে নিকট আত্মীয় ছাড়া তেমন কারও সঙ্গে মিশত না। যেহেতু একটি কাজ খারাপ করেছে, এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা ক্ষমা চাই। ওকে যেন ক্ষমা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ও আর এ ভুল করবে না।
সদর উপজেলার তেলিখালী এলাকার বিজয় বলেন, বায়েজিদ খুব ভালো একটি ছেলে ও সহজ-সরল রাজনৈতিক তেমন কোনো পরিচয় নেই। বায়েজিদ ঢাকায় থাকে। ওর টিকটিক করার স্বভাব রয়েছে। তারা তিন ভাই বর্তমানে সবাই ভালো পজিশনে আছে এবং ভালো চাকরি করে।
সদরের লাউকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন মানিক বলেন, বায়েজিদের পরিবার একটি ধার্মিক পরিবার। বায়েজিদ বা তার পরিবার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামের নির্মাণশ্রমিক মো. আলাউদ্দিন মৃধা ও পিয়ারা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বায়েজিদ তালহা মৃধা ছোট। বড় ছেলে সিপন মৃধা খুলনা কাস্টমস রেভিনিউ অফিসার ও মেজ ছেলে সোহাগ মৃধা পটুয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করেন।