বাংলাদেশের দুই যুগ আগে যে সেতুর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল, সেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ জেলা রাজধানী ঢাকা এবং বাকি অংশের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হয়ে গেলো।
বেলা পৌনে ১২টার দিকে সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ১২টার দিকে মাওয়া প্রান্তে একটি উদ্বোধনী ফলক উম্মোচন করেন তিনি।
গাড়িযোগে সেতু পার হয়ে জাজিরা প্রান্তে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উম্মোচন করার কথা তার।
উদ্বোধনের আগে মাওয়া প্রান্তে এক সুধী সমাবেশে দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এই সেতু নির্মাণের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।’
‘অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহুকাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে আছে। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয় এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমসাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা আর জেদ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। আশা করা হচ্ছে, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে এবং প্রতি বছর দশমিক আট-চার শতাংশ হারে দারিদ্র বিমোচন হবে।’
সুধী সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি গাড়িবহর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজা অতিক্রম করে।
সেখানে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি পদ্মা সেতুর প্রথম টোল প্রদান করে।
এর মধ্যে দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হয়ে যায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা।
আগে যে পথ ফেরির মাধ্যমে পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেতো, এখন সেটি পার হওয়া যাবে মাত্র সাত মিনিটে।
তবে সবার ব্যবহারের জন্য রোববার সকাল থেকে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে।
দ্বিতল এই সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে রেল সংযোগের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে সেতুটি তৈরি করা হয়েছে।
এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। এসব জেলায় এর মধ্যেই সেতু ঘিরে নানারকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি আর পরিবহনে ব্যাপক চাঞ্চল্য
শরীয়তপুরের বাসিন্দা মনির হোসেন বলছেন, ‘ঢাকা আমাদের এখান থেকে মাত্র এক শ’ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলেও সন্ধ্যা হলে আর আমরা যাতায়াত করতে পারতাম না। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই ফেরি বন্ধ হয়ে যেতো। কতবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে নদী পার হয়েছি। সেইসব কষ্টের আজ যেন অবসান ঘটতে যাচ্ছে।’’
সেতুর দুই পাড়ে আনন্দ
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিনে দুই পাড়ে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছেন।
মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে যদিও শুধুমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিদের অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
সকাল ১০টার দিকে সেখানে এসে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু মূল সমাবেশ স্থলে যেতে না পারলেও আশেপাশের এলাকায় অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন বলে সেখান বিবিসি সংবাদদাতা কাদির কল্লোল জানাচ্ছেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাদারীপুরের শিবচরে একটি জনসভায় অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোর থেকেই সেখানে কয়েক লাখ মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘিরে ঢাকা-মাওয়া এবং জাজিরার টোল প্লাজা থেকে শরীয়তপুর ও ভাঙ্গা মহাসড়কের দুই পাশে নানা ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।
অনেক স্থানে আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে পদ্মা সেতুতে অসংখ্য ট্রলার, নৌযান ঘুরতে দেখা গেছে, যেগুলা রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে।
সেতুর ফলক উন্মোচনের পর মাদারীপুরের শিবচরে জনসভায় অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেখানে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের সমাগম হবে বলে আশা করছেন দলটির নেতারা।
শেষ ফেরি
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ফেরি ‘কুঞ্জলতা’ এবং ‘বেগম রোকেয়া’ ফেরির মাধ্যমে পদ্মা নদীতে ফেরির মাধ্যমে নদী পার হওয়ার যুগের সমাপ্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বিভক্তকারী বিশাল পদ্মা নদীতে এতদিন দুটি পয়েন্ট দিয়ে ফেরি চলাচল করতো।
এসব ফেরির মাধ্যমে ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকা ও বাকি অংশের যোগাযোগ হতো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীর স্রোত এবং ফেরি স্বল্পতায় সেই যোগাযোগ প্রায়ই ব্যাহত হতো, অনেক সময় লাগতো।
শুক্রবার সন্ধ্যায় মাওয়ার শিমুলিয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরার উদ্দেশ্যে চলে যায় ফেরি কুঞ্জলতা। আর মাঝিরকান্দি থেকে শিমুলিয়ায় আসে ফেরি বেগম রোকেয়া।
তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর জরুরি প্রয়োজনের জন্য সীমিত আকারে এই রুটে ফেরি চলাচলের সুযোগ থাকবে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ
১৯৯৯ সালে প্রথম তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শুরু করে।
এরপর সম্ভাব্যতা যাচাইসহ নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একনেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন হয়।
দুই হাজার এগারো সালে এই সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করার জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার।
কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক চুক্তি থেকে সরে যায়। পরে অন্য সংস্থাগুলোও সরে যায়। যদিও পরে সেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
২০১২ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।
পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে।
পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু তথ্য
পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন থাকবে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের ব্রিজ হচ্ছে, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটার।
দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।
সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল করবে, রেল চলবে নিচের অংশে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এই বছরের ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
সূত্র : বিবিসি