সুনামগঞ্জ: ‘ঠিকানা শুধু এক সমাধি, সাড়ে তিন হাত মাটি’। জনপ্রিয় একটি ব্যান্ডদলের ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’ শিরোনামে এই গানটি এক সময় ছিল মানুষের মুখে মুখে। আদতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার গন্তব্য সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরেই। কিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেটে এখন কেউ মারা গেলে দাফনের জন্য সেই মাটিটুকুও মিলছে না। বন্যার ডানায় ভর করে এসেছে দুঃসহ, অবর্ণনীয় এক পরিবেশ। দিনের পর দিন পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হচ্ছে লাশ, দাফনের জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ প্রিয়জনের দেহ ভাসিয়ে দিচ্ছে অথই জলে। তুলনামূলক অবস্থাসম্পন্নরাই কেবল অনেক দূরে উঁচু অঞ্চলে অন্যের জমিতে নিয়ে লাশ দাফন করছেন।
উজানে প্রতিবেশী আসাম ও মেঘালয়ে ঝরা টানা বৃষ্টির পানি পাহাড় গড়িয়ে ঢল হয়ে নামে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। প্লাবিত হয়েছে সিলেটসহ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা। বন্যার পানি এবার আছড়ে পড়ছে দেশের মধ্যাঞ্চলীয় জেলাগুলোয়ও। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা জগন্নাথপুর। গত সোমবার ঢলের সঙ্গে ভেসে আসে কাফনবন্দি একটি লাশ। পরে স্থানীয়রা সেটি উদ্ধার করে দাফন করেন। তবে শুকনো মাটি পাননি সেই হতভাগাও। হাওরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সবখানেই পানি। লাশ দাফনের জায়গায় নেই। এ কারণে হয়তো কেউ ভাসিয়ে দিয়েছিল মরদেহটিকে।
তাহিরপুরের টাঙুয়ার হাওর এলাকাও এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী। কবর দেওয়ার জায়গা না পেয়ে কলাগাছের ভেলায় অথই জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এক মায়ের লাশ। ভেলায় ভাসিয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যরা নীরবে চোখের জল ফেলে। তাদের আশা, কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি নিশ্চয়ই লাশটির দাফনের ব্যবস্থা করবেন। তাই মাকে কবর দেওয়ার আকুতি জানিয়ে সঙ্গে চিরকুট লিখে দেন সন্তান। তাতে লেখা- ‘শুকনো জায়গায় মাকে কবর দিও’। উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মুরাদ বলেন, ‘নয়নগর গ্রামেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। রেণু মিয়ার দুই বছরের ছেলে আল-আমিন বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়। শুকনো জায়গায় কবর দিতে না পেরে বুকের ধনের লাশ সেই জলেই ভাসিয়ে দেন মা-বাবা।’
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম বরনি গ্রামে সোমবার মধ্যরাতে মারা যান বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ আবদুস শহীদ। কিন্তু দাফন হবে কোথায়? আশপাশের কোথাও কবর খোঁড়ার জায়গাটুকু যে নেই। সবখানেই কেবল পানি আর পানি। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল পাশের উপজেলা ভোলাগঞ্জের একটি টিলায় কবরের জায়গা পাওয়া গেছে। ১৫ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। কোনোরকম মাটিচাপা দিয়ে বাড়ি ফেরেন স্বজনরা। স্থানীয়দের আফসোস- নিজ বাড়ি, কবরস্থান, নিজ গ্রাম কোথাও ঠাঁই হলো না আবদুস শহীদের।
বানের জলে ভাসা গোয়াইনঘাটের পূর্ব বরনি গ্রামেও সম্প্রতি মৃত্যু হয় আবদুল মালেক নামে একজনের। ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। তার বেলায়ও অসহায়ত্ব, কবর খোঁড়ার জায়গা নেই। কাফনের বন্দোবস্ত করতে করতে স্বজনরা অপেক্ষা করছিলেন পানি কমার। যদি কবরস্থানে ঠাঁই দেওয়া যায় এ প্রিয়জনকে! জৈন্তাপুরের ছাতাইর খাঁ হাওরের দুর্গম গ্রাম আমিরাবা। পানিবন্দি মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নাজমুন্নেছা। সঙ্গে ছিল ১৪ বছরের ছেলে আবদুর রহমান। শুক্রবার বিকালে মেয়েকে দেখে ফিরছিলেন মোহালীপাড়া নিজ বাড়িতে। হাওরের পাশ দিয়ে রাস্তার ওপর তখন প্রবল ঢল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন নাজমুন্নেছা। ছেলে আবদুর রহমানসহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই প্রলয়ঙ্করী ঢল। এর পর গত মঙ্গলবার হাওরে ভাসতে দেখা যায় মা-ছেলের লাশ।
সুনামগঞ্জ উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ আলী ও সাজু মিয়া নামের দুজন বৃদ্ধ গত শুক্রবার মারা যান। একই এলাকার দুই বাসিন্দার লাশ দাফন নিয়েও অপেক্ষায় স্বজনরা। কারণ তাদের কবরস্থানেও কোমর পানি, গ্রামের কোথাও শুকনো জায়গা নেই। অবশেষে পরিবারের লোকজন দাফনের জায়গা না পেয়ে লাশ দুটি বাক্সবন্দি করে বাঁশ পুঁতে আটকে রাখেন কবরস্থানে। লাশ যাতে ভেসে না যায়, সে জন্য পাহারাও দেন স্বজনরা। ছয় দিন পর গতকাল বুধবার কবরস্থানের সামান্য জায়গা ভেসে ওঠায় আশরাফ আলীকে দাফন করা হয়। সাজু মিয়াকে দাফনের মতো মাটি এখনো ভাসেনি। আশরাফ আলীর ছেলে ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছি। বাবা সেখানেই মারা যান। বাড়িতে হাঁটুপানি। ঘুম-খাওয়া কিছুই হয়নি। বাবার লাশ এভাবে কবরে রেখে কীভাবে ঘুমাই বলেন!’ আর সাজু মিয়ার মেয়ে মিনা বেগম বলেন, ‘বন্যার সময় বাড়ি আসার পথে বাবা রাস্তায় মারা যান। কিন্তু পানির কারণে লাশ দাফন করতে পারিনি। কফিনে ভরে কবরস্থানে বাঁশ পুঁতে বেঁধে রেখেছি। পানি কমলে আজ-কালই বাবাকে দাফন করব।’ সাজু মিয়ার জামাতা সালাতুল ইসলাম বলেন, ‘দুদিন ধরে আমার শ্বশুর আর ছেলের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। পরে একজন এসে খবর দেয় আমার শ্বশুর মারা গেছেন। ঘরবাড়ি সব ফেলে নৌকা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাই গোবিন্দগঞ্জ। সেখান থেকে লাশ এনে এখন বাক্সের ভেতর ভরে রেখেছি। পানি কমলে মাটি দেব।’
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা বললেন, ‘আমার গ্রামের দুই বৃদ্ধ গত শুক্রবার মারা গেছেন। কিন্তু কবরস্থানে পানি থাকায় লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি। আগামীতে কবরস্থানগুলো মাটি ভরাট করে উঁচু করব। এ জন্য অবশ্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’