বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় ৩০ জেলার ১৭৯টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও বন্যায় দেশের ৩৫ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণভাবে আর ২৮০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার বড় অংশ রয়েছে কুড়িগ্রামে।
কুড়িগ্রামে অনেকগুলো নদী থাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও রয়েছে বেশ কয়েকটি। কিন্তু এবার এমন অনেক এলাকায় পানি উঠেছে, যেখানে গত কয়েক দশকে কোনো বন্যা হয়নি। এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা নদী রক্ষা বাঁধগুলোর ভেঙে যাওয়াকেই দায়ী করলেন।
কুড়িগ্রামের বাংটুরঘাটে ধরলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ঘুরে দেখা যায়, অনেক স্থানে বিশাল বিশাল খাদ হয়ে আছে। স্থানীয়রা বলেন, প্রবল স্রোতের সাথে পানি আসায় বাঁধ ভেঙে এ অবস্থা হয়েছে।
বাঁধটি যখন ভাঙ্গে, তখন সেটি ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা নুর আলম।
তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে বাঁধের নদীর পাশে পানি বাড়তেছিল। যখন ইদুরের গর্ত দিয়ে ঝিরঝির করে পানি এদিকে আসতে শুরু করলো, তখন মাটি ও বালুর বস্তা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটা বন্ধ করি তো আরেকটা খোলে যায়। প্রায় ১০০ জনের মতো সারারাত চেষ্টা করলাম। মাটি দিলাম, বস্তা দিলাম, গাছপাতা দিলাম। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে হুরুম করে বাঁধ ছুটে গেল। আর আমরাও যে যেদিকে পারলাম ছুটলাম।
তার স্ত্রী আজিমুনন্নেসা বেগম তখন ঘরের মালামাল গোছগাছ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘কদিন ধরিই বাঁধের ওইপাশে পানি বাড়ছিল। সোয়ামি গেছি বাঁধ ঠেকাতে। যখন হুনি, পানি ঢুকবার লাগছে, তখনি ছাওয়াল আর বালিশ কাঁথা নিয়ে বাঁধের উপরই গিয়ে উঠলাম।’
যে বাঁধ ভেঙে তাদের বাড়িঘর ভেসে গেছে। আশ্রয়ের জন্য তাদের আবার সেই বাঁধের উপরই এসে দাঁড়াতে হচ্ছে। পুরো বাঁধজুড়ে দেখা যায় অসংখ্য মানুষ সেখানে ছাপড়ার মতো ঘর বানিয়ে বাস করছেন। যতদিন নিজেদের ঘরবাড়ি ঠিক না হচ্ছে, ততদিন তাদের সেখানেই থাকতে হবে।
তাদের সাথে রয়েছে তাদের হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু।
বাঁধের উপর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ করছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা বলেন, বাঁধের উপর মানুষের বসবাস বাড়ছে, তাই খাবারের লোভে ইঁদুরও বেড়েছে। সব ইঁদুরের গর্ত (র্যাটহোল) অনেক লম্বা হয়। ফলে নদীর পানি বাড়লে এসব গর্তে ঢুকে তা আরো বড় করে ফেলে। আর এসব গর্ত যেসব স্থানে বাঁধের নীচের দিকে থাকে, সেখানে পানি ঢুকে বড় ফাটল তৈরি হয় বা বাঁধ ভেঙে ফেলে।
বাঁধ দিয়ে হাঁটার সময় অনেকগুলো গর্ত দেখা গেলো। এর কিছু কিছু হয়তো ইঁদুরের তৈরি, আবার কিছু প্রাকৃতিক বা মানুষের কারণেও হতে পারে। বাঁধ ভাঙ্গার পর কিছু গর্ত বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষা বা তদারকির দায়িত্ব যে সংস্থার, সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, নদীতে যখন পানি আসে তখন দু’দিকের পানির লেভেলের তারতম্যের কারণে পানি চুইয়ে আসে।
একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত মাটির বাঁধগুলো বন্যা ঠেকাতে পারে। কিন্তু এর বেশি হলে সেটা ভেঙে যায়। আবার অনেক সময় বাঁধের ভেতর ছোট ছোট ফাঁকা থাকে। সেটা নানা কারণেই হতে পারে। পানি বা বাতাস চলাচল, ইঁদুরের যাতায়াত অনেক কারণে হতে পারে।
জানা গেছে, কুড়িগ্রামে ২১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ২৩ কিলোমিটারের এখন ক্ষতিগ্রস্ত। জায়গায় জায়গায় পুরো বাঁধ ভেঙে পানির মধ্যে তলিয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি বাড়তে শুরু করলেই এসব স্থান থেকে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে।
ধরলার ডান তীরের বাঁধ ভেঙে পানি এমন সব জায়গায় ঢুকে পড়ে, যেখানে গত কয়েক দশকে কোনো বন্যা হয়নি। কুড়িগ্রাম-রংপুর সড়কটিও অনেক দিন পানির নিচে তলিয়ে ছিল।
স্থানীয়রা জানান, নদীর পানি বাড়তে শুরু করার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড আর স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা সেখানে যান। তারা বেশ কিছু গর্ত, ফাটল চিহ্নিত করে সেখানে বালুর বস্তা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু তাদের অভিযোগ, এসব কাজ হয়েছে একেবারে শেষ বেলায়, যখন আর কোনো উপায় নেই। আগে থেকে যদি বাঁধের নিয়মিত সংস্কার করা হতো, তাহলে মানুষের এই ভোগান্তি হতো না।
স্থানীয় হলুখোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, বাঁধের দায়িত্ব ওয়াপদার। প্রতি বছর এটার মেরামত করার নিয়ম। কিন্তু তারা তা করে না। দুই-তিন বছর কিছু ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেয় কিন্তু তারা মেরামতের বদলে বাঁধ চেচে আরো চিকন করে ফেলে। দক্ষিণ হলোখালা থেকে শুরু করে পাঙ্গারচর পর্যন্ত বহুকাল ধরে কোনো মেরামত হয় না। পানির চাপে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
বাঁধগুলো ঠিকমতো সংস্কার হয় না, এমন অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকেৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ বড় ধরণের বাঁধের কাজ হয়েছিল ২০০৫-২০০৬ সালে। এর বড় কারণ, বরাদ্দের অভাব। লোকবলেরও অভাব রয়েছে। তবে প্রতিবছরই কিন্তু আমরা জেলা পর্যায়ে কম-বেশি কাজ করি।
তিনি বলেন, এর আগে অনেক বাঁধ ভেঙ্গেছে কিন্তু সেগুলো আর ঠিক করা হয়নি। ফলে সেখান থেকে অনেক এলাকায় পানি উঠেছে। কুড়িগ্রামে ২১০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে কিন্তু আগের বন্যায় বা নদীভাঙ্গনে এর মধ্যে ২৩ কিলোমিটার বাঁধই খোলা রয়েছে। ফলে সেখান দিয়ে পানি উঠেছে।
কর্তৃপক্ষ এখন বাঁধগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। কর্মকর্তারা বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেবেন। একই সাথে তারা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাঁধের ওপর যে মানুষজন অবৈধভাবে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে, তাদের সরিয়ে দিয়ে বাঁধগুলোকে খালি করা হবে।
সূত্র : বিবিসি