তাইওয়ানকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে অস্ত্র ধরবে বলে সম্প্রতি চীনকে উদ্দেশ করে হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মাধ্যমে তাইওয়ান ইস্যুতে ওয়াশিংটনের কৌশলগত ‘অস্পষ্ট অবস্থানের’ দীর্ঘ কয়েক দশকের নীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেন বাইডেন। তবে পাল্টা জবাব দিয়ে বেইজিং জানায়, তাইওয়ানের স্বাধীনতার যেকোনো প্রচেষ্টা কঠোর হাতে দমন করবে তারা। দুই মোড়লের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থান শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়াবে কি না, তা নিয়ে নতুন
তাইওয়ানের স্বাধীনতায় সমর্থন দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে রোববার (১২ জুন) চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি বলেন, ওয়াশিংটন ‘তাইওয়ানের বিষয়ে তার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করছে’ এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এশীয় নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা ডায়ালগে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কেউ যদি চীন থেকে তাইওয়ানকে আলাদা করার সাহস দেখায় আমরা যুদ্ধ শুরু করতে দ্বিধা করব না। আমরা যেকোনো মূল্যে এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই করব। এটিই চীনের সামনে একমাত্র পথ।’
তাইওয়ানের আকাশসীমার কাছাকাছি যুদ্ধবিমান ওড়ানোর মাধ্যমে চীন ‘বিপদ নিয়ে খেলছে’ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন জো বাইডেন। দ্বীপটিকে সামরিকভাবে রক্ষা করারও অঙ্গীকার করেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই মূলত ‘প্রয়োজনে যুদ্ধ শুরু’ করার হুঁশিয়ারি দেয় বেইজিং।
তাইওয়ানকে বরাবরই চীন নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। অন্যদিকে তাইওয়ানের দাবি, তারা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সবচেয়ে বড় মিত্র মনে করে তাইওয়ান এবং দ্বীপটিকে রক্ষায় সহায়তার বিষয়ে ওয়াশিংটনের একটি আইনও রয়েছে।
তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে প্রতিনিয়ত যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে চীন। এমনকি গত মাসেই নিজেদের যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় বহরটি পাঠায় বেইজিং। অন্যদিকে তাইওয়ানের জলসীমায় সম্প্রতি নৌ জাহাজ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয় কথার যুদ্ধ। এই কথার যুদ্ধই একপর্যায়ে প্রকৃত সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে কি না, এখন সেই প্রশ্নই তুলতে শুরু করেছেন অনেকে।
ব্যবধান মাথায় রাখা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। এবার চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালালে নতুন আরেক যুদ্ধ শুরু হবে, এটিই এখন বড় ভয়। বেইজিং এর আগেও বলেছে যে তারা প্রয়োজনে জোর করে হলেও তাইওয়ান দখল করবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত সেই শঙ্কা নেই।
তাইওয়ান আক্রমণ করে সফল হওয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা চীনের আছে কি না তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি নিজেদের আকাশ ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে তাইওয়ান। কিন্তু অনেকেই একমত যে শুধুমাত্র চীনের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই এ ধরনের পদক্ষেপ খুব ব্যয়বহুল এবং বিপর্যয়কর হবে। এমনকি বেইজিংও তা স্বীকার করে।
ইনস্টিটিউট অব সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম চুং বলেন, তাইওয়ান ইস্যুর সঙ্গে ইউক্রেন সংকটেরও অনেক মিল রয়েছে। ফলে চীনারা যদি তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাতে চায় তাহলে তাদের এই ব্যবধানটা খুব সতর্কতার সঙ্গে সাথে মাথায় রাখতে হবে। কারণ চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে অনেক বেশি আন্তঃসংযুক্ত।
চীনের ধারাবাহিক অবস্থান হলো যে তারা তাইওয়ানের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন’ চায়। এ বিষয়টিই রোববার পুনর্ব্যক্ত করেছেন জেনারেল ওয়েই। শুধুমাত্র কোনো উসকানির সম্মুখীন হলেই বেইজিং যুদ্ধ শুরু করবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যদি তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে কৌশলের সঙ্গে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তাইওয়ান ইতোমধ্যেই একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে দাবি করেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন।
তাইওয়ানের বেশিরভাগ নাগরিক প্রেসিডেন্টের এই অবস্থানকে সমর্থন করেন, যা ‘স্ট্যাটাস কো’ বা ‘স্থিতাবস্থা বজায় রাখা’ নামেও পরিচিত। যদিও তাদের একাংশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথে এগোতে চায়।
একইভাবে, এশিয়ায় একটি ব্যয়বহুল সামরিক সংঘাতে জড়াতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্রও। এমনকি বাইডেন প্রশাসন এরইমধ্যে বিভিন্ন উপায়ে ইঙ্গিতও দিয়েছে যে তারা যুদ্ধ চায় না।
এশীয় নিরাপত্তা সম্মেলন শাংরি-লা ডায়ালগে অংশ নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না এবং ‘নতুন শীতল যুদ্ধও’ চায় না।
এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো কলিন কোহ বলেন, তাইওয়ান নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই তাদের অবস্থানে অটল। এক্ষেত্রে নিজেদের শক্ত অবস্থানই দেখাতে চায় তারা, যাতে সরে আসা বা পিছু হটার মতো কোনো দুর্বলতা প্রকাশ না পায়। কিন্তু একই সময়ে তারা সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর বিষয় নিয়েও খুব সচেতন। তারা নিয়মিত একে অপরের বক্তব্যের দিকে নজর রাখছে এবং উভয় পক্ষই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছে।
কলিন কোহ’র মতে, সিঙ্গাপুরে নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইউলাইন বৈঠকে চীন ও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে বসার বিষয়টি ইতিবাচক। এর মাধ্যমে উভয় পক্ষই দেখাতে চেয়েছে যে তারা এখনও পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতে এবং দ্বিমত থাকা বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আসতে ইচ্ছুক।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের বৈঠক দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করবে এবং সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো থেকে তাদের বিরত রাখবে। তবে অদূর ভবিষ্যতেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথার যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে বলেই মনে করা হচ্ছে।