চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চার শতাধিক মানুষ দগ্ধ হয়েছেন। আর মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৫ কর্মী রয়েছেন।
সবশেষ খবর অনুযায়ী আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করছে। দগ্ধ ও আহতদের মধ্যে ১৯ জনকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ২১ জন এবং পুলিশের ১০ সদস্য রয়েছেন।
এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ তিনজনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়েছে। সকাল আটটার দিকে (রোববার) তাদের অ্যাম্বুলেন্স যোগে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন মাগফারুল ইসলাম (৬৫) ও খালেদুর রহমান (৬০)।
বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন জানান, তাদের দুজনেরই শরীরের ১২ শতাংশ করে দগ্ধ হয়েছে। তাদরকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্য ও তার আরেক সহকর্মীকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যের নাম মো. তুহিন। তিনি সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের কনস্টেবল। তার সঙ্গে একই থানার গুরুতর আহত কনস্টেবল কামরুলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
শনিবার (৪ জুন) রাতে আগুন লাগার ১১ ঘণ্টা পার হলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন। কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পরই আবার বিস্ফোরণ হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। আগুন নেভানোর বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিস্ফোরণ যেভাবে হচ্ছিল তাতে ভেতরে থাকা সম্ভব ছিল না। আগুন কতক্ষণে নেভাতে পারব, এ বিষয়ে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
এদিকে কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কেমিকেল কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস।
জানা যায়, পানি সংকটে কন্টেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। ভোরের দিকে এসে পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে পারছিলেন না।
রাত ২টার থেকেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পানি নিয়ে সংকটে পড়তে হয়। ডিপোর ভেতরে আটকে থাকা ট্রাকগুলো একে একে ফায়ার সার্ভিসের পানির পাইপের ওপর দিয়ে যেতে থাকে। এতে বেশ কয়েকটি পাইপ ফেটে যায়। প্রচুর পানির অপচয় হয় ওই সময়।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আগুন লাগার সময় বড় একটি বিস্ফোরণের পর আরও ১৫-২০টি বিস্ফোরণ ঘটে। ভোর ৪টার দিকেও আরও একবার বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন শিকদার বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ২১ কর্মী আহত হয়েছেন। সর্বশেষ ২৪টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করছে।
রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা রক্তের জন্য হ্যান্ডমাইকে একের পর এক ঘোষণা দিচ্ছেন। যাদের রক্তের প্রয়োজন এবং যারা রক্ত দিতে চান তাদের যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সবাইকে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের দিকে যেতে বলা হচ্ছে।
চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেডসহ মোট আইসিইউ বেড মাত্র ১৯টি। সব বেডেই অগ্নিকাণ্ডে আহতরা চিকিৎসাধীন আছেন।
রাতেই চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন।
এ অবস্থায় আইসিইউ সংকট দেখা দিলে রোগীদের চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচে) আইসিইউতে নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস হোসেন চৌধুরী জানান, দগ্ধ ও আহতদের হাসপাতালের বিভিন্ন ইউনিটে নেয়া হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন। সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সব চিকিৎসকদের হাসপাতালের আসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
জরুরি বিভাগ, বার্ন ইউনিট, সার্জারি ইউনিটসহ অন্যান্য সব ইউনিটকে এখন অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধদের সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিএম ডিপোতে আগুন থেকে কন্টেইনারে বিস্ফোরণে আহতরা সবাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসেছেন, এখনো আসছেন। সব চিকিৎসক ও নার্সদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জড়ো করেছেন। রক্ত দেয়ার জন্য লোকজন জড়ো করা হচ্ছে।
তিনি চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার এ বক্তব্য যারা শুনছেন চমেক ও অন্য যত ডাক্তার চট্টগ্রামে থাকেন তারা সবাই নিজ নিজ এপ্রোনটা পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলে আসুন।
এদিকে হাসপাতালে অযথা ভিড় না করতে স্থানীয় জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইউসুফ বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে উৎসুক জনতা ভিড় করছে। এ কারণে আহতদের হাসপাতালে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। মহাসড়ক এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের টহল দল কাজ করছে, যেন আহতদের দ্রুত হাসপাতালে আনা যায়।
ফৌজদারহাট লিংক রোড বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান বলেন, রাত পৌনে ৩টার দিকে সীতাকুণ্ড থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স শহরের দিকে প্রবেশ করে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো যাতে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আশেকুর রহমান বলেন, আরও রোগী হাসপাতালে আসছেন। তাদের মধ্যে শ্রমিক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মী এবং সাধারণ মানুষও আছেন। আহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাত ৮টার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কন্টেইনার থেকে অন্য কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। একটি কন্টেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিকসহ অনেকে হতাহত হন।