ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তার জেনারেলরা সম্প্রতি একটি অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দোনবাসের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে সামরিক বাহিনীকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন তারা। সরে না আসলে তারা সেখানে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারেন বলে শঙ্কা রয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হয়। পশ্চিমাদের সমর্থনে সামনে থেকেই জেলেনস্কিকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। এতে তিনি সাধারণ মানুষের সমর্থনও কুড়িয়েছেন। গেল ২৪ মে এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ৬৪ শতাংশ ও দক্ষিণাঞ্চলের ৮৩ শতাংশ মানুষ শান্তির বিনিময়ে ভূখণ্ডগত ছাড় দিতে অনিচ্ছার কথা জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার বিনিময়ে ভূমি ছেড়ে দিতে পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ক্ষুব্ধ জেলেনস্কি তাকেও ছেড়ে কথা বলেননি। ৯৮ বছর বয়সী কিসিঞ্জারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ২০২২ সাল কিসিঞ্জারের পঞ্জিকা না, তিনি ১৯৩৮ সালেই পড়ে আছেন।
জেলেনস্কি মূলত মিউনিখ চুক্তির কথা বলেছেন। তখন নাৎসি জার্মানিকে চেখোস্লোভাকিয়ার ভূমি একীভূত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই ঘটনা ঘটেছিল।
আক্রোশ ঝেড়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন—যারা ভূমি ছাড় দিতে পরামর্শ দেন, তাদের ভূরাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় সাধারণ মানুষ নেই। তাদের বাদ দিয়েই তারা রাজনৈতিক চিন্তা করেন। আপনাদের সাধারণ মানুষের দিকে তাকাতে হবে।
দোনবাসে রুশ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে চরম সত্যের মুখোমুখি তার এই উদ্ধত স্পর্ধা। যুদ্ধ গ্রাস করে নিয়েছে পুরো প্রদেশটিকে। রোববার পর্যন্ত অঞ্চলটির প্রায় চল্লিশটি বসতিতে হামলা হয়েছে।
গেল সপ্তাহে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলে ইউক্রেনের ভঙ্গুর সম্মুখসারি স্থবির হয়ে পড়েছে। বিপদ তাদের ঘিরে ধরেছে। দেশটির উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালইয়ার বলেন, দোনবাসে সর্বশক্তির লড়াই চলছে।
অনিশ্চয়তায় ইউক্রেন
বলা যাচ্ছে, রাশিয়ার অনুকূলে যাচ্ছে লড়াইয়ের ফল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যে খবর আসছে, তাতে পরিস্থিতি বদলের আভাস দিচ্ছে। যে কারণে ইউক্রেনের নেতাদের কাছ থেকেও হতাশাজনক বিবৃতি আসছে। তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিবর্তন আনছেন। তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে।
ছয় সপ্তাহের ভয়াবহ লড়াইয়ের পর দোনবাসে চোঙাকৃতির ইউক্রেনীয় সম্মুখভাগের অবস্থা গুরুতর। সেখানে নাজুক অবস্থায় কিয়েভ সেনারা।
যুদ্ধের বড় বড় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে চারটি ছোট প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি হয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিয়েছে। হামলার ঝুঁকিতে পড়ার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো এই ছোট সম্মুখসারিগুলো। এটা খুবই বিপজ্জনক। লড়াইয়ের জন্য এটা জ্বলন্ত উনুনের মতো টগবগ করছে। প্রতিরক্ষা ব্যূহগুলো শত্রু সেনারা ঘিরে রেখেছে। এ অবস্থায় একমাত্র উপায় হলো দ্রুত পালিয়ে যাওয়া কিংবা পাল্টা হামলার জন্য সহায়ক বাহিনীর অপেক্ষায় থাকা।
এছাড়া বিকল্প হলো শত্রুদের হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়া কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের পূর্বপ্রান্তের প্রতিরক্ষা ব্যূহ: সেভেরোদোনেৎসক ও লিসিচানৎসক। গেল ২৬ মে-র প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফল দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ক্রমাগত সেভেরোদোনেৎসকের দিকে এগোচ্ছে। আসছে দিনগুলোতে সেভেরোদোনেৎসক ও লিসিচানৎসককে পুরোপুরি ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে।
তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে সোমবার (৩০ মে) সেভেরোদোনেৎসকে রাশিয়ার সেনারা ঢুকে পড়েছে। লুহানস্কের গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেন, মস্কো বাহিনীর শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছে চলে আসছে। তারা শহরটিকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে। লড়াই এখন অবিশ্বাস্য রূপ নিয়েছে।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দুটো ব্রিগেড অঞ্চলটিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। শহরটি এখন তাদের মর্টারের আওতায়। যুদ্ধের আগে সেভেরোদোনেৎসকের জনসংখ্যা ছিল একলাখ ১০ হাজার। বর্তমানে তা কমে এসেছে ১৫ হাজারে।
একটি ৮২ এমএম মর্টারের আওতা তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার মিটার। তার মানে, শহরটি পদাতিক বাহিনীর সরাসরি হামলার ঝুঁকিতে। এতে পরিস্থিতি দ্বিগুণ বিপজ্জনক হয়ে গেছে। শহরের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সেভেরোদোনেৎসকের কেবল একটি সেতু কার্যকর আছে। এতে দুই দিকে ভাগ হয়ে রুশ সেনারা সহজেই হামলা চালাতে পারবে।
সেতুটি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যোগাযোগ লাইন (এলওসি), রসদ ও গোলাবারুদ সরবরাহের পথ। আহতদের এ পথ দিয়েই নিরাপদে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এখন তা ব্যাপক ঝুঁকিতে। যদি ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য কিংবা অনুমতি দেওয়া হয়, তবে সেতুটিতে এসে তারা অবরোধের শিকার হতে পারে। শত্রুর মুখোমুখি হয়ে সেনাপ্রত্যাহার করে নিলে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিণতিতে পড়তে হয়।
এতদিন আশাবাদী থাকলেও ২৭ মে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাও হতাশার খবর দিয়েছে। তাদের মতে, পোপসানার কাছে কয়েকটি গ্রাম দখল করে নিয়েছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। সেভেরোদোনেৎসকের পশ্চিমের লিসিচানৎসকও বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে। যুদ্ধের আগে সেখানে এক লাখ তিন হাজার সেনা ছিল। কৌশলগত শহর পোপসানা থেকে পনেরো কিলোমিটার উত্তরে অগ্রসর হয়েছে রুশ বাহিনী। চলতি মাসেই পোপসানা দখলে নেয় তারা।
পাশাপাশি রুবিজনে কিংবা ক্রেমিনা থেকে দক্ষিণে ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে রাশিয়ানরা। এতে সেভেরোদোনেৎসক ও লিসিচানৎসকও লড়াইয়ের উত্তপ্ত ময়দানে পরিণত হতে পারে।
এরআগে হামলাপ্রতিরোধে ইউক্রেনীয় বাহিনী বারবার তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পরিচিত একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, রুশ বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অর্থাৎ রাশিয়াকে হটিয়ে নিজেদের ভূমি উদ্ধারের আশা ছাড়েনি তারা।
রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত
দোনবাসে ইউক্রেনীয় সম্মুখসারির জন্য চরম ঝুঁকি থাকলেও চূড়ান্ত আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। ছয় সপ্তাহের যুদ্ধে তাদের অগ্রযাত্রায় ওঠানামা আছে। এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিচক্ষণতা অবলম্বন করছে। এ পর্যন্ত তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো করে লড়ছে।
কামানের ধ্বংসাত্মক গোলা ও ক্ষেপণাস্ত্র তাদের প্রধান অস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো সাঁজোয়া অভিযান চালাবে রাশিয়া এমনটা মনে করেছিল সামরিক বিশেষজ্ঞরা। রাশিয়ার সামরিক মহড়া পরিকল্পনাকারীদের পছন্দ হলো সাঁজোয়া অভিযানের মাধ্যমে কোনো দেশের গভীরে প্রবেশ করা।
কয়েকদিন বা ঘণ্টার মধ্যে সেভেরোদোনেৎসকে রুশ বাহিনী ঢুকে যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সেখানে আগেভাগেই রাশিয়ার বিজয় ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রা ছিল সংযত সীমিত। এসব সত্ত্বেও দোনবাসে ইউক্রেনীয় বাহিনীর ভঙ্গুরতার অর্থ হচ্ছে, রাশিয়ার অভিযান আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হবে।
হরলিভকা থেকে উত্তরে ও লিম্যান থেকে দক্ষিণে এ রকম একটি হামলার শঙ্কা করা হচ্ছে। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত থাকবে এই অভিযানের আওতা। অথবা প্রতিরক্ষা ব্যূহের একেবারে পশ্চিম প্রান্তেও অভিযান চালানো হতে পারে।
ইজিউম থেকে দক্ষিণে ও দোনেৎসকের উত্তরেও একটি হামলা হতে পারে। কেরামাতোরেৎসক বা স্লোভিয়ানৎসকের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে কিংবা পরিবহন কেন্দ্রভূমিতে এসে দুই ভাগে বিভক্ত রুশ বাহিনীর দেখা হতে পারে। এমন অভিযানের আওতা হবে ১৪০ কিলোমিটার।
তবে ইজিউমে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অব্যাহত প্রতিরোধের মুখে রাশিয়া। এতে তারা দক্ষিণাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে অক্ষম হতে পারে। প্রথম লড়াইয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে রাশিয়ার বাহিনী। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তারপর এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অথচ ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনার অটুট মনোবল তাদের আছে কিনা?
গেল ৯ মে রাশিয়ার একটি পন্টুন সেভেরোদোনেৎসক নদী পার হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অভিযান বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হয়েছে। ইউক্রেনের কামানের গোলার আঘাতে রাশিয়ার একটি ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপ বড় ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে এসেছে।
দোনবাসে ইউক্রেনের বড় প্রতিরক্ষা ব্যূহকে ছোট ছোট অংশে ভেঙে দিতে চাচ্ছে রাশিয়া। এতে মস্কোর জন্য লড়াই আরও সহজ হয়ে যাবে। ২৪ মে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ও হতাহত এড়াতে ধীর গতিতে এগোচ্ছে রাশিয়া।
তার এই ঘোষণা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা কম হয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ধীরে ও সতর্কতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করছে রুশ বাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সামরিক সূত্র বলছে, ক্রেমলিন ফের ভুলের মধ্যে পড়তে চায় না। ছোট অঞ্চল দখল করে আরও অর্জনযোগ্য উদ্দেশ্যের দিকে যাওয়ায় হারানোর কিছু নেই।
রুশ বাহিনীর এই কৌশলে কাজ দিচ্ছে। ২৬ মার্চ পিজিএস হিসাব করে জার্মান ও যুক্তরাষ্ট্রের সূত্র বলছে, দোনবাসে এ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহের চেয়ে আরও বেশি ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে রাশিয়া।
মন্থর হামলায় দিন শেষে জয় আসবে
ধৈর্যের সঙ্গে ধীরে-সুস্থে হামলা চালিয়ে রাশিয়া যে সফলতা পেয়েছে, তার সঙ্গে কিছু পর্যবেক্ষকের মতামত মিলছে না। তারা দাবি করেন, বর্তমান-প্রজন্মের প্রতিরক্ষা অস্ত্র দিয়ে মস্কোর হামলা প্রতিরোধ করা হয়েছে। এতে পুতিন বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে।
একইভাবে যারা বলছেন, রাশিয়ার ট্যাংক পুরনো, সেকেলে—তাদের বক্তব্যের সঙ্গে মারিউপোলের ভিডিও পরস্পরবিরোধী। কারণ ভিডিওতে দেখা গেছে, রাশিয়ার ট্যাংক থেকে ছোড়া গোলা কতটা কার্যকরভাবে শত্রুব্যূহ ধসিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া বড়াই করার মতো অপটিক্যাল সাইট, ধ্বংসাত্মক কামান ও সম্মুখসারির ভারী সাঁজোয়া যানে বিভিন্ন ভবনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে রাশিয়ার কমান্ডাররা। ইউক্রেনের ভেতরে তারা অনেকটা ভেবেচিন্তে এগোচ্ছে। আক্রমণাত্মক যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো—অনেক বেশি লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু হলে তাতে সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করায় ব্যর্থতা অনিবার্য। এতে কৌশলগত ব্যর্থতার পাশাপাশি লোকবল, সরঞ্জাম ও সম্মানও হারাতে হবে।
প্রথম দিকে রাশিয়ার ব্যর্থতার ক্ষতকে গভীর করেছে ছত্রভঙ্গ কমান্ড কাঠামো, সরু-প্রতিরক্ষা ব্যূহ ও সড়কভিত্তিক আক্রমণ। আর বিনাখরচেই একটি তথ্যযুদ্ধের সুফল পেয়েছে ইউক্রেন। কিয়েভের পক্ষ হয়ে ব্যাপকভাবে খবর প্রচার করছে সামাজিকমাধ্যম ও পশ্চিমা মিডিয়া। অভিযানের প্রথম দিকে রাশিয়ার লজ্জাজনক পিছু হটায় অন্ধ হয়ে গেছে পশ্চিমারা। যে কারণে বর্তমানের নির্মম বাস্তবতা তাদের চোখে পড়ছে না।
রাশিয়ার অগ্রাযাত্রাকে তারা আড়ালে রাখতে চাচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে রুশ সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসার পরেই মারিউপোলের পতন ঘটেছে। বেলগোরোদ সীমান্তে রুশ নাগরিকদের রক্ষায় লড়াই যদিও অব্যাহত রয়েছে। কিয়েভ থেকে সেনাপ্রত্যাহার করেই দোনবাসে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে ক্রেমলিন।
বর্তমানে আবহাওয়া ও ভূখণ্ড—দুটোই রাশিয়ার অনুকূলে। সামরিক অভিযানের প্রথম দিকে যেটা ছিল না। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে মে মাসের প্রথম পর্যন্ত ব্যাপক বরফ গলনে ইউক্রেনের ভূমি কাদায় পরিণত হয়ে যায়। এতে রাশিয়ার সাঁজোয়া যানগুলো সড়কে আটকে গিয়েছিল। ফলে ক্রেমলিনের সেনাবহর ও রসদ স্থবির হয়ে পড়ায় তাদের ওপর কিয়েভের অতর্কিত হামলা সহজ ছিল।
কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় রাশিয়ার সামরিক বাহিনী স্বস্তির সঙ্গে সাঁজোয়া যান মোতায়ন করছে। সড়কের বাইরে গিয়ে ক্রেমলিনের স্বয়ংক্রিয় কামান চলাচল করতে পারছে। দোনবাসে দিন বড় হয়ে যাওয়া ও বিস্তৃত খোলা জায়গার কারণে রাশিয়া নিজেদের মতো কৌশল বাস্তবায়ন করছে।
যে কারণে দোনবাস দখলে বড় বড় ভ্রাম্যমাণ অভিযান চলছে। যদি অঞ্চলটি থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তবে সেই সুযোগ পরিপূর্ণ বিজয় অর্জনে কাজে লাগাবে রাশিয়ার সাঁজোয়া যান। সামরিক সূত্র বলছে, এতে শহরগুলোর পতন ত্বরান্বিত হবে। দ্রুতই দোনবাস রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
এ ঘটনা হবে ইউক্রেনের জন্য বিপর্যয়কর। কারণ মারিউপোলের চেয়ে দোনবাসের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আজভসাগর উপকূলবর্তী শহরটিতে সড়কে দুই পক্ষের প্রাণঘাতী লড়াই হয়েছে। আর একটি ইস্পাত কারখানা থেকে দুই হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় সেনাকে আটক করা হয়েছে।
কিয়েভ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর মারিউপোলে দুটি হালকা পদাতিক ইউনিট ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা হলো, উগ্র-ডানপন্থী আজভ রেজিমেন্ট ও একটি স্বতন্ত্র নৌব্রিগেড।
দোনবাসে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধানশক্তি ভারী পদাতিক বাহিনী—মোটরাইজড ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডস, এয়ারমোবাইল ব্রিগেডস, কামান ও সাঁজোয়া ইউনিট। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব ইউনিট লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দোনবাসে এসব ইউনিটের বিকল্প নেই।
গোলাবারুদের হিসাবনিকাশ
তবে এ যুদ্ধে সবকিছুই রাশিয়ার অনুকূলে বলে দাবি করা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি জনবল ও গোলাবারুদের হিসাবে ইউক্রেন এগিয়ে। জরুরিভিত্তিতে সেনা সংগ্রহ করে মাটি রক্ষায় অনমনীয় লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে ইউক্রেন। সেই জনসংখ্যা ও অস্ত্র দেশটির আছে। আর পশ্চিমাদের কাছ থেকেও অস্ত্র সহায়তা জোরদার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলো উদারভাবে কিয়েভের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
যুদ্ধের প্রথম দিকে কাঁধে বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে কামান ও সাঁজোয়া যান পেয়েছে ইউক্রেন। পশ্চিমাদের কাছ থেকে আসা ভারী অস্ত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে কিয়েভের যুদ্ধবহর। কিন্তু ইউক্রেনের অপ্রশিক্ষিত জনবলের অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও নিয়মিত ইউনিটের জনশক্তির জায়গা পূরণ করার মতো জনবল ও গোষ্ঠী তাদের আছে।
কিন্তু সম্মুখসারিতে ইউক্রেনের অস্ত্রবহর ধ্বংস ও সরবরাহ বন্ধ করতে সফল হওয়ার দাবি করেছে রাশিয়া। তাতে অবশ্য ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ হয়নি। গোলাবারুদের সংকট থাকলেও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো অ্যাসল্ট রাইফেল ও ভারী কামান ব্যবহার করতে পারছে ইউক্রেনীয় বাহিনী।
এদিকে রাশিয়ার জনবল সীমিত। ক্রেমলিনকে পেশাদার বাহিনীর ওপর নির্ভর করে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পুরোদমে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে জনবল নিয়োগ দিতে পারছে না রাশিয়া। এতে তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। ২৫ মে পেশাদার সেনাদের জন্য উচ্চ-বেতনের প্রস্তাব দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এদিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বয়স চল্লিশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করে আইন পাস করেছে দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ স্টেট দুমা।
ইউক্রেনের সম্মুখসারিতে ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপ (বিটিজি) পুনরায় মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে মস্কো। সংঘাতে প্রাণহানি ও ক্লান্তির খেসারত দেওয়ার আগে তারা কতটা কার্যকর থাকে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেনাদের মনোবলও সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া বিশেষভাবে পদাতিক বাহিনীর ঘাটতিতে পড়েছে। যুদ্ধের বিপজ্জনক সংস্করণে সড়কে লড়াইয়ে অনিয়মিত শক্তি হিসেবে তাদের খ্যাতি আছে। পোপসানা পতনে ভাড়াটে সেনা ওয়াংগার গ্রুপ ও চেচেন হালকা পদাতিক বাহিনী ছিল মূল যোদ্ধা। মারিউপোলে চেচেন ও দোনবাস মিলিশিয়ারা একই ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া যুদ্ধ সরঞ্জাম খোয়ানোয় চাপে পড়েছে রাশিয়া। আর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ত্রাহি দশায় দেশটির অস্ত্র শিল্প। টুইটারে দেওয়া এক ব্রিফিংয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, ফেলে রাখা টি৬২ ট্যাংক ইউক্রেনে মোতায়েন করেছে রাশিয়া। ১৯৬১ সালে প্রথম অস্ত্রটি বাজারে উন্মুক্ত করা হয়েছিল।
গোলাবারুদের খরচ রাশিয়াকে আরেক বিপদে ফেলেছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অস্ত্র নিয়েও চাপে ক্রেমলিন। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ১২ মাসের মধ্যে রাশিয়ার কামানোর গোলা ফুরিয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি তখনই লেগে যাবে।
এদিকে দোনবাসের ভাগ্য ঝুলে আছে। দুপক্ষই নিজেদের বিজয় দাবি করছে। প্রথম দিকে রাশিয়ার আকস্মিক হামলাগুলো ঠেকিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন। এরপর রুশ বাহিনী কিয়েভ ও দ্বিতীয় বৃহৎ শহর কারকিভ ঘিরে ফেলতে চাইলেও তাও ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এতে হামলাকারীরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের লড়াইয়েও জয়ী হয়েছে কিয়েভ।
এতে রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন টিকে যায়। আর জনসংখ্যার দুটি কেন্দ্রভূমি থেকে যায় কিয়েভের কক্ষপথে। দক্ষিণের খেরসন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ক্রিমিয়ার নিরাপত্তা ও জলনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। মারিউপোলে কঠিন লড়াই শেষে হেরে যায় ইউক্রেন।
এতে দেশটির আজভ সাগরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে দোনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ঘাঁটি গেড়েছে। আর ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়াকে যুক্ত করে পূর্ব-পশ্চিম উপকূলীয় করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ নিশ্চিত করেছে রাশিয়া। এতে লড়াইয়ে সমানে সমান আছে রাশিয়া-ইউক্রেন।
কিন্তু দোনবাসই কেবল যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু না। রাশিয়ার বাহিনী সেনাদের জড়ো করে নিপার উপত্যকায় হামলা চালাতে উত্তরাঞ্চলে অভিযান জোরদার করছে। জ্যাপোরিজজিয়া দখলে নিতে পারলে নিপার থেকে ইউক্রেনকে বিচ্ছিন্ন করার মতো উপযুক্ত অবস্থানে চলে যাবে রাশিয়া। কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের জাহাজ চলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক করিডোর হাতিয়ে নিতে পারবে ক্রেমলিন।
এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের মিকোলেইভে হামলা নবায়ন করার আভাস দিচ্ছে রাশিয়া। এটি কৃষ্ণসাগরের ওডিসা বন্দরে যাওয়ার প্রধান স্থলপথ। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক সূত্র বলছে, জুলাইয়ে মিকোলেইভের পতন ঘটতে পারে।
হিসাব মতো সবকিছু ঘটলে তা হবে ইউক্রেনের জন্য বেদনাদায়ক। আজভ সাগর থেকে দেশটি ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে একটি স্থলসীমান্তবিশিষ্ট দেশে পরিণত হয়ে যাবে ইউক্রেন।