শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। ক্রমাগত খাদ্য ও অর্থসংকট, চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাল। সত্তর বছরে ভারত মহাসাগরীয় দেশটিতে এতো ভয়াবহ সংকট আগে দেখা যায়নি।
শ্রীলঙ্কার ২২ কোটি জনসংখ্যা জরুরি অবস্থার মধ্যে আছে। বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করলে রনিল বিক্রমাসিংহে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। সহিংসতায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন নিহত, আহত হয়েছেন তিনশতাধিক। দেশজুড়ে চলছে কারফিউ।
এসব সংকটের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ চ্যানেল স্কাইনিউজ। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, সরকারের হঠকারী নীতি ও পদক্ষেপে বিক্ষোভের আগেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। ঋণে জর্জরিত দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পূর্ণ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে তা আমদানি অসম্ভব।
দেশটির অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি পর্যটন শিল্প। এই শিল্পে ভর করেই অর্থনৈতিক মুক্তি খুঁজতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুটো ঘটনা এই শিল্পকে ডুবিয়েছে। পুরোপুরি বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট।
বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বোয় ২০১৯ সালের এপ্রিলে দফায় দফায় ইস্টার সানডে সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে বিস্ফোরণে ২৫০ জনের মতো নিহত হন। জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এর দায় স্বীকার করে।
এই ভয়াবহতার প্রভাব পরে পর্যটন শিল্পে। দেশটির অর্থনীতি সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। কিন্তু বেশি দিন না যেতেই দ্বিতীয় আঘাতটি আসে করোনাভাইরাস মহামারি থেকে। বোমা হামলায় অর্থনীতির ক্ষতটাকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে এই ভাইরাস।
এতে ভারত মহাসাগরীয় দেশটির অন্য খাতগুলোও বিপর্যস্ত হয়েছে। মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। পোশাক শিল্প ও নির্মাণখাতও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক নীতি। ইস্টার বোম্বিংয়ের পরেই দেশটির জাতীয় নির্বাচন হয়। এতে বিজয়ী হওয়া প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে জনগণের কাছে বড় বড় অঙ্গীকার করেন। জনতুষ্টি অর্জনে মানুষকে অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। এছাড়া ইস্টার সানডের শঙ্কা থেকে জনগণও এমন এক প্রার্থীকে ভোট দিতে চেয়েছেন, যার বিদ্রোহ দমনের অভিজ্ঞতা আছে।
তার বড় মাহিন্দা রাজাপাকসে নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী। এই দুই ভাইয়ের সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অধিকাংশ পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশ করে দেয়। এছাড়া আরও সাতটি কর বিলুপ্ত করে। লঙ্কার ইতিহাসে আগে কখনো এমন কর-হার হ্রাসের ঘটনা ঘটেনি।
দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী এ-সিদ্ধান্তকে ভুল বলে স্বীকারও করেন। তিনি বলেন, তাদের নেওয়া নীতির কারণে ১০ লাখ করদাতা হারিয়েছে সরকার। কেবল তা-ই না, এই কর হ্রাসের কারণে পরবর্তী বছরে তাদের ক্রেডিট রেটিং তলানিতে চলে যায়। কারণ অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় শ্রীলঙ্কায় রাজস্ব আদায় হয়েছে কম।
ক্রিডিট রেটিং বলতে সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধ ঝুঁকির মূল্যায়ন বোঝায়। ঋণগ্রহীতা একটি কোম্পানি, সরকার কিংবা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। ঋণ নেওয়ার পর তা কতটা পরিশোধের সক্ষমতা রাখে, ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে তা যাচাই হয়।
এতে শ্রীলঙ্কা কেবল বৈদেশিক মুদ্রা খুইয়েছে—তা-ই না—নতুন ঋণগ্রহণের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে। রাজাপাকসে সরকারের এটিই অবিমৃষ্য নীতিগত পরিবর্তনের শেষ না। ২০২১ সালে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। তখন ব্যাপক কৃষি উৎপাদনের কারণে অর্থনীতির আট শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু ওই বছর মে মাসে রাসায়নিক সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে।
মূলত অর্গানিক ফসল উৎপাদনে জোর দিতেই এই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু তাতে ফল আসে হিতে বিপরীত। এতে কৃষকের উৎপাদনে ধস নামে, বেড়ে যায় খাদ্যপণ্যের দাম।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সর্বশেষ ধাক্কাটি আসে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর। কারণ এতে পণ্য আমদানি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে যায়। অন্য দেশগুলোর মতো লঙ্কায়ও খাদ্যপণ্যের মূল্য ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়।
সব সংকটের দায় চাপে রাজাপাকসে সরকারের ওপর। তাদের পদত্যাগ দাবিতে মানুষ কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ করেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান মাহিন্দা রাজাপাকসে। পদত্যাগ করেন মন্ত্রিসবার সদস্যরা।
জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় দিনের অধিকাংশ সময়ই দেশটির নাগরিকদের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে। শাকসবজি ও ফলমূলের উৎপাদনও কমেছে। এক বিক্ষোভকারী বলেন, আমাদের মূল সমস্যা অর্থনৈতিক। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ না করাও একটা সমস্যা। তিনি সরে না-দাঁড়ানো পর্যন্ত আমাদের মূল সমস্যার সুরাহা হবে না। কেউই এখন শ্রীলঙ্কায় একটি ডলারও পাঠাতে চায় না। কাজেই তার পদত্যাগ প্রয়োজন।
লঙ্কান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নির্ভর করছে জরুরি ভিত্তিতে অন্য দেশ থেকে ঋণ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থছাড়ের ওপর। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না-আসলে তা সম্ভব না। কিন্তু গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ না করলে সেই আশায়ও গুড়েবালি।