গাজীপুর: রাজনীতি আর দেশ পরস্পর পরস্পরকে আষ্টেপিষ্টে থাকে। যে কোন শাসন আমলই বলি না কেন, রাজনীতি নির্ভর হবেই। রাজনীতির ভেতরে বা বাহিরে যে কোন জায়গায় একটি দেশের সরকার অবস্থান করে। রাজনীতিতে উত্থান-পতন রাজনীতির কারণেই হয়। এটা চিয়ায়ত এবং বাস্তবতা। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গাজীপুর একটি ভিন্ন আবহে বিরাজ করছে। কারণ স্বাধীনতা শুরু ও শেষ গাজীপুর থেকেই হয়েছে।
গাজীপুর জেলার ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসকে নতুন গতি দিয়েছে যা আর কোন জেলা দিতে পারেনি। বাংলাদেশের গাজীপুরে প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরের কৃতি সন্তান বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ জন্মের আগে-পরে যে সকল ইতিহাস গাজীপুরের ছেলেরা সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে এসব ঘটনা অন্যতম।
এছাড়া বাংলাদেশ জন্মের আগে ইতিহাসের মধ্যমনি হয়ে আছে ৫২ সনের মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদ গাজীপুরের সিংহ পুুরুষেরা। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে গাজীপুর একটি ভিন্ন জায়গা তৈরী করেছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যতগুলো সরকার হয়েছে তার মধ্যে প্রায় সব সরকারেরই মন্ত্রী পরিষদের এক বা একাধিক সদস্য গাজীপুরে থাকে। এর কারণ হিসেবে গাজীপুরের মানুষ মনে করে, মহান ভাষা আন্দোলন, প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ ও প্রথম প্রধানমন্ত্রীর গাজীপুরে হওয়ার কারণেই আমরা প্রধান্য পাই। নিঃসন্দেহে গাজীপুর গর্ব করতে পারে। এই ইতিহাস বহমান থাকবে যতদিন দুনিয়া থাকবে।
গাজীপুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহুরুপি। কার পদ কখন আসে, কখন যায়, বলা মুশকিল। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারীর মত অবস্থা এখানে। হঠাৎ ঘূর্নিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয়। বিগত বিএনপির সরকারের সময় তারেক রহমানের নামে ঘুষ নেয়ার কথা বলে দল থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন অধ্যাপক এম এ মান্নান। ছেলে কর্তৃক দলের বিরুদ্ধে কথা বলায় পদ হারান বিএনপির স্থায়ী কমিটর সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। ২০২১ সালে একটি অডিওতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করার অভিযোগে দলীয় পদ ও গাজীপুর সিটির মেয়র পদ হারান জাহাঙ্গীর আলম। এসব ঘটনায় কোন তদন্ত কমিটির কোন প্রক্রিয়া চোখে আসেনি। এর অর্থ হল, বড় দুটি দল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ পেয়েই এ্যাকশনে যায়। এসব ঘটনা বলে দেয়, আওয়ামীলীগ বা বিএনপি কেউ দলের বিরুদ্ধে কথা বলাকে বরদাস্ত করে না। আর করার কথাও না। কারণ দলের গঠনতন্ত্র বলছে, জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে কথা বললে এমপি পদও থাকবে না। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এ ধরণের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর ও কালিয়াকৈরে দুইজন স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন তদন্ত কমিটি গঠন হওয়ার খবর নেই। একই সাথে পূর্বের ধারাবাহিকতারও কোন বাস্তবতা নেই। অথচ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রিয়ভাবে বার বার দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপের হুসিয়ারী দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দলের বিরুদ্ধে গেলেও কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে, আর কার বিরুদ্ধে হবে না, সেটা কেউ জানেনা। অভিযোগ উঠার সঙ্গে সঙ্গে কখনো কখনো ব্যবস্থা হচ্ছে আবার অনেক পরেও ব্যবস্থা গ্রহন হচ্ছে না, তাও সকলের অজানা। তবে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে এটা সঠিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের লেখালেখিই বলে দেয়া অসঙ্গতি বিদ্যমান।
পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর পৌরসভা নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থীর ইশারা ইঙ্গিতে বুঝা যায়, নৌকা পরাজিত হওয়ার পিছনে সরকারী দলের নেতারাই দায়ী। অথচ এ বিষয়েও কোন পদক্ষেপ নেই। কিছুদিন আগে হয়ে গেলো শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন। সম্মেলনের আমন্ত্রন পত্র দেখেই বুঝা গেছে কোন না কোন অসঙ্গতি ছিল। আগামী ১৯ মে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, গাজীপুর-১(কালিয়াকৈর) আসনের এমপি ও মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী এডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক। সম্মেলন সঞ্চালনা করবেন গাজীপুর-৩( শ্রীপুর) আসনের এমপি ও গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ। এই সম্মেলকে ঘিরে আমন্ত্রনপত্রে নাম না থাকায় অনেকটা প্রকাশ্যেই ক্ষোভ বিরাজ করছে। সম্মেলন স্থলের স্বাগতিক এমপি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের নাম নেই আমন্ত্রন পত্রে। নাম নেই আরো দুই জন এমপির। তারা হলেন নারী সাংসদ সামসুন্নাহার বেগম ও অধ্যাপিকা রুমানা আলী টুসী। বাদ পড়েছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের প্রধান প্রধান নেতাদের নাম। আমন্ত্রনপত্রে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ছাত্র সংগঠনের নেতাদের। রাজপথ কাঁপানো অনেক বড় পদের নেতাদেরও স্থান হয়নি আমন্ত্রনপত্রে।
–ফাইল ছবি
এই অবস্থায় গাজীপুর জেলা, মহানগর ও সকল উপজেলা আওয়ামীলীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি হতাশা বিরাজ করছে। তাদের দাবী, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের প্রক্রিয়া যদি পক্ষপাতমূলক হয় তবে দলের অভ্যন্তরে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ হতে থাকবে। আর তা হবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জন্য অকল্যানকর।
আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দাবী, তাদের প্রাণের দল যেন সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি দিয়ে একটি সুন্দর সম্মেলন উপহার দেয়। না হলে গাজীপুর আওয়ামীলীগে নানা ধরণের সমীকরণ দলকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।