সমঝোতা ও আপসের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের নির্দেশনা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের থামছেই না। এমনকি করোনা মহামারীর সময়েও কৃষকদের বিরুদ্ধে হাজারো মামলা হয়েছে। মহামারীর দুবছরে সরকারি ছয় ব্যাংক মিলে ৭ হাজার ৮০০টি মামলা করেছে। একই সময়ে রেকর্ডসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তিও হয়েছে। তার পরও ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কৃষকদের বিরুদ্ধে অনিষ্পন্ন সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা ছিল সোয়া লাখের বেশি।
‘সরকারি পাওনা আদায় আইন-১৯১৩’-এর বিধান মোতাবেক যে মামলা চালু করা হয়, তাকে সার্টিফিকেট মামলা বলা হয়। এসব মামলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কৃষকের নামে আদালতের পরোয়ানা জারি রয়েছে। ১০-২০ হাজার টাকার জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও পরোয়ানা জারির ঘটনাকে অমানবিক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, মহামারীর সময় অন্যান্য ঋণগ্রহীতা যত ছাড় পেয়েছে, কৃষকদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। ফলে করোনার মধ্যেও কৃষকদের নামে সার্টিফিকেট মামলা করেছে ব্যাংকগুলো। এটা অবশ্যই অমানবিক। কারণ করোনায় অন্য অনেকের মতো কৃষকরাও খুব জীবনযাপন করেছেন। তবে এটাও ঠিক যে ব্যাংকগুলোর মাঠপর্যায়ে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে কৃষকদের কাছে সরাসরি গিয়ে ঋণ আদায়ে তদারকি সেভাবে হয় না। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর কৃষকের অজান্তেই সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে ব্যাংকগুলো। গত বছর টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। খেলাপিদের প্রায় সবাই ক্ষমতাধর ধনিক-বণিক শ্রেণি। এদের অনেকের রাষ্ট্রক্ষমতার ‘আশীর্বাদ’ রয়েছে।
পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের টাকা আদায়ে ‘দ্য পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি অ্যাক্টের’ (পিডিআর) আওতায় কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলা করতে পারে সরকারি ব্যাংকগুলো। একজন কৃষক ৩ বছর কোনো টাকা জমা না দিলে সেটি তামাদি হয়ে যায়। তখন ওই কৃষকের নামে মামলা করা যায় না এবং তার কাছ থেকে টাকা দাবিও করা যায় না। তাই বিদ্যমান আইন পরিপালন ও পাওনা আদায়ে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয় বলে দাবি ব্যাংকারদের।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে কৃষকের ব্যাপক অবদান আছে। তাই ৫, ১০ ও ২০ হাজার টাকার জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করাটা ব্যক্তিগতভাবে আমারও পছন্দ নয়। কিন্তু আইন রক্ষার জন্য আমাদের বাধ্য হয়েই এ ধরনের মামলা করতে হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে কৃষকদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা শুরু করে ব্যাংকগুলো। এর পর থেকে মামলা বাড়তে থাকে। এমনকি আদালতের পরোয়ানায় কৃষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটে। সামান্য টাকার জন্য কৃষকদের এমন নাজেহাল করার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ছোট অঙ্কের ঋণগ্রহীতা কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর বেশ কয়েক বছর সার্টিফিকেট মামলা কমে এলেও তা আবার বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘কৃষকদের বিরুদ্ধে যাতে মামলা করতে না হয়, সে জন্যই বিভিন্ন সময়ে কৃষি ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তা ব্যাংকগুলো মানতে বাধ্য। কোনো ব্যাংক যদি সার্কুলারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মামলা করে থাকে এবং সেটি যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে প্রমাণিত হয়, তা হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত মাসেও সমঝোতার মাধ্যমে (সোলেনামা) সার্টিফিকেট মামলা স্থগিত বা নিষ্পত্তি করে কৃষকের খেলাপিঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিতে আবারও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ব্যাংক নিজেই ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করতে পারবে। ক্ষেত্রবিশেষে বিনা ডাউন পেমেন্টেও কৃষিঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। ঋণগুলো পুনঃতফসিলের তারিখ থেকে ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ তিন বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। আগে পুনঃতফসিল করা হয়েছে, এমন স্বল্পমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রেও নতুন এ সুবিধা পাবেন কৃষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সারাদেশে কৃষকদের বিরুদ্ধে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, কৃষি ও রাকাবের মোট সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৬৪টি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কৃষকদের কাছে ৪৩৫ কোটি ২৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ছয় ব্যাংকের সারাদেশে এক লাখ ৪৫ হাজার ২১১ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। এসব মামলায় ব্যাংকগুলোর পাওনা ছিল ৪৭৭ কোটি ৭১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরে মামলা কমেছে ১৫ হাজার ১৪৭টি। আর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সারাদেশের এক লাখ ৯৫ হাজার ৩৪৯ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। এসব মামলায় ব্যাংকগুলোর পাওনা ছিল প্রায় ৫৮৮ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, কৃষকের বিরুদ্ধে ২০২০ ও ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গত দুই বছরে বিশেষায়িত এ ব্যাংকটি ৫ হাজার ২৩টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ হাজার ৭৯৮টি ও ২০২১ সালে ২ হাজার ২২৫টি। এর পরই রয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ব্যাংকের মাধ্যমে গত দুবছরে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৬৫৯টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৭৮টি ও ২০২১ সালে ১ হাজার ২৮১টি। মামলা দায়েরে তৃতীয় অবস্থানে আছে বিশেষায়িত ব্যাংক রাকাব। ব্যাংকটির গত দুবছরে মামলার সংখ্যা ৬৯৯টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৫৭৯টি ও ২০২১ সালে ১২০টি। এ ছাড়া গত দুই বছরে অগ্রণী ব্যাংক ১৯৯টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১১৫টি ও ২০২১ সালে ৮৪টি। তবে গত বছর নতুন করে একটিও মামলা করেনি জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। তবে ২০২০ সালে জনতা ব্যাংক ১৫১টি ও রূপালী ব্যাংক ৬৯টি মামলা দায়ের করেছিল।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও তাগাদার কারণে গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সার্টিফিকেট মামলা নিষ্পত্তি করেছে ব্যাংকগুলো। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত দুই বছরে ৩০ হাজার ৮১৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১২ হাজার ৬৩৮টি ও ২০২১ সালে ১৮ হাজার ১৭৭টি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি করেছে বিকেবি। ব্যাংকটির নিষ্পত্তিকৃত মামলার পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৯১টি। এ ছাড়া গত দুই বছরে অগ্রণী ব্যাংক ৪ হাজার ৭২৩টি, রাকাব ৩ হাজার ৭১০টি, জনতা ব্যাংক ২ হাজার ২০৪টি, সোনালী ব্যাংক ১ হাজার ৯৬৬টি ও রূপালী ব্যাংক ৬২১টি সার্টিফিকেট মামলা নিষ্পত্তি করেছে।
বড় বড় শিল্পপতিদের চেয়ে কৃষকদের ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। তাই অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষি খাতে দেওয়া ঋণে খেলাপির পরিমাণও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা ঋণস্থিতির ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণস্থিতি ৬ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৪৯ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণস্থিতির ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।