ঢাকা: ভেঙ্গে পড়েছে জাতীয় পার্টির চেইন অব কমান্ড। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামনেই বিবাদে জড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতার। সম্প্রতি এরশাদের কক্ষেই সাংগঠনিক সম্পাদককে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করতে উদ্যত হন একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য।
কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছে, ‘শঙ্খলা পরিপন্থী এসব কর্মকান্ডের কারণে কারোরই বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। যে কারণে প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতি দলের জন্য অশনিসংকেত। এতে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্ব-সংকট দেখা দিতে পারে।’
অতীতের যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেসময় দোষীদের বিচার হলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। অতীতের ঘটনাকে হালকাভাবে নিলেও এরশাদের কক্ষেই রিভলবার উঁচিয়ে গুলি করতে যাওয়ার ঘটনাকে সহজভাবে নিতে পারছেন না সিনিয়র নেতারা।
তারা জানিয়েছেন, গত ১১ মার্চ দুপুরে বনানীতে উত্তরের মেয়র প্রার্থী বদলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের হয় জাপার কর্মী সমর্থকদের। ওই সময়ে বনানী কার্যালয়ে অফিস করছিলেন এরশাদ।
বাইরে মিছিলের শব্দ শুনে ‘কিসের মিছিল’ জানতে চান এরশাদ। মিছিলের নেপথ্যে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক জানান উত্তরের প্রার্থী বদলের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন পার্টির লোকজন।
মোস্তাকুর রহমান আরও বলেন, উত্তরের ঘোষিত প্রার্থী বাহাউদ্দিন বাবুলের মার্ঠ পর্যায়ে সমর্থন নেই। তার বদলে অন্য প্রার্থী দেওয়া দরকার। না হলে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। এ কথায় চটে যান বাবুলপন্থী বলে পরিচিত মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী।
তিনি ধমক দিয়ে থামাতে চান মোস্তাককে। এ সময় মোস্তাক প্রতিবাদ করলে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত ফয়সল চিশতী পকেট থেকে রিভলবার বের করে মোস্তাককে গুলি করার হুমকি দেন। পরে উপস্থিত নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিত শান্ত হয়।
তবে ওই ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। প্রতিবাদে ১৩ মার্চ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে মোস্তাকের সমর্থকরা। তারা এসএম ফয়সল চিশতীকে বহিষ্কারের দাবি করেছেন। এ ঘটনায় বিব্রত এরশাদ মোস্তাককে ফোন করে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন বলে জানা গেছে।
এর আগে ১ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভামঞ্চেও লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিলো। ব্যানার প্রদর্শন নিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপিকে মারতে তেড়ে গিয়েছিলেন ফয়সল চিশতী। তখনও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এরশাদ। কিন্তু নেতাদের সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না। পরে সিনিয়র নেতারা উত্তেজিত দুই নেতাকে দু’দিকে নিয়ে গিয়ে শান্ত করেন।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৪ সালের ২৫ জুন। আইডিইবি ভবনে জাতীয় মৎস্যজীবী পার্টির এক অনুষ্ঠানেও এরশাদের উপস্থিতিতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেদিন এরশাদ বসেছিলেন ঠিক মাঝখানে আর দু’দিকের চেয়ারে ছিলেন এরশাদের আপন ভাই প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের ও পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
অনুষ্ঠানসূচিতে ছিলো জিএম কাদের’র বক্তব্যের পর বক্তব্য দেবেন মহাসচিব। এরপর এরশাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সভা শেষ হবে। এ অবস্থায় জিএম কাদের বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। জিএম কাদের তার বক্তব্যে একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলে থাকা নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থানকে ‘দ্বি-চারিতা’ বা ‘দ্বিমুখি অবস্থান’ অভিহিত করেন। এতেই ক্ষেপে যান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। মঞ্চে বসেই ধমক দিয়ে ওঠেন তিনি। তারপরও জিএম কাদের বক্তব্য চালিয়ে যেতে থাকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে যান বাবলু। বিব্রত এরশাদ একেবারেই নীরব বসে থাকেন মঞ্চে। না ভাইকে-না মহাসচিবকে কাউকেই কোনো কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। অন্য নেতারা মহাসচিবকে আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ক্ষিপ্ত মহাসচিব শেষমেষ বক্তব্য না দিয়েই চলে যান। অবস্থান নেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতির কক্ষে।
পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে নিয়ে সভামঞ্চ ছাড়েন এরশাদ। যান ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতির কক্ষে। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন মহাসচিব। ওই কক্ষে আবার জিএম কাদের ও বাবলুর মধ্যে বচসা হয়।
এছাড়া সম্প্রতি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সিরাজুল ইসলামকে বক্তব্য দিতে না দিলে তিনিও ক্ষুব্ধ হন। তখন বক্তব্য রাখছিলেন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তারপর প্রধান অতিথি এরশাদের বক্তব্য দেওয়ার কথা।
কিন্তু শেখ সিরাজুল ইসলামকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হন অন্যরা। মঞ্চ ছেড়ে উঠে যেতে উদ্যত হন। পরে সিরিয়াল ব্রেক করে সিরাজুল ইসলামকে বক্তব্য দেবার সুযোগ দেওয়া হলে সে-যাত্রা রক্ষা হয়। এর বাইরে মঞ্চে বসা নিয়ে ঠোকাঠুকির ঘটনা অহরহই ঘটছে। সিনিয়রিটি মানছেন না কেউ, সভামঞ্চে সামনের সারি দখল করে রাখছেন জুনিয়র নেতারা।
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, তারা মনে করছিলেন, অতীতের ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেও সর্বশেষ রিভলবার উঁচিয়ে গুলির হুমকি প্রদর্শনের ঘটনায় চৈতন্য ফিরবে এরশাদের। দোষীদের বিরুদ্ধে এবার অন্তত ব্যবস্থা নেবেন! কিন্তু সেই ঘটনার ৭দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় নি। এ-কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা যারপরনাই ক্ষুব্ধ, হতাশ।
প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, কেউ বেয়াদবি করলে এরশাদ ক্ষমা করেন না। আমার মনে হয়, যথা সময়ে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। দলের চেইন অব কমান্ডে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না জানতে চাওয়া হলে জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি ওনার (এরশাদ) পার্টি, উনিই ভালো বুঝবেন।
পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার খেয়াল-খুশিমতো দল চালান। যোগ্য ব্যক্তিকে যথাস্থানে না বসিয়ে অযোগ্যদের স্থান দিয়েছেন। ৩৯ ধারাবলে বিনা কারণে যখন যাকে খুশি বহিষ্কার এবং পদায়ন করছেন। এমনকি তার সহধর্মিনীকেও একাধিকবার বহিষ্কার করেছেন।
ব্যক্তিগত পছন্দ -অপছন্দ অথবা ঘনিষ্ঠদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এরশাদ। আবার ঘনিষ্ঠরা তাদের অপছন্দের লোককে শায়েস্তা করতে কানভারি করছেন এরশাদের। এতে অনেক ক্ষেত্রে কাজও হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্রেফ বিনা কারণে হঠাৎ কাউকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এমনকি কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে। জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা এমন খেদই প্রকাশ করলেন।
তারা জানিয়েছেন, এমন অনেক নেতা রয়েছেন মাঠপর্যায়ে যাদের কোনই গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্তু এরশাদের বাসায় নিয়মিত ঘুরঘুর করেন তারা। অথবা অন্য কোনোভাবে এরশাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন তারা। তারা অন্যদের ডিঙিয়ে রাতারাতি নেতা বনে যাচ্ছেন। আর ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।দুর্বল হয়ে পড়ছে জাপা।
কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরশাদের স্ট্যান্টবাজিতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাপা। এরশাদের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দুই শতাধিক প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় এরশাদের জন্য মাঠে নামার চেষ্টাও করেছিলেন প্রত্যাহারকারী নেতারা।
তখন স্পষ্ট দু’টি ধারা তৈরি হয়েছিল দলে। একটি নির্বাচনে না যাওয়ার গ্রুপ, আরেকটি গ্রুপ রওশনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। যারা এরশাদের নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন, তারা আশা করেছিলেন এরশাদ মুক্ত হলে পরীক্ষিত সৈনিক হিসেবে তাদেরকেই বুকে টেনে নেবেন আর সুবিধাবাদী নেতাদের ছুঁড়ে ফেলবেন। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উল্টোটা।
যারা এরশাদের কথা অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের আজ জয়জয়কার। তারাই এখন ডাবল-ট্রিপল প্রমোশন পেয়ে চালকের আসনে। আর এরশাদের কথা মেনে যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন তারা যেমন হতাশ, তেমনি হতাশ তৃণমূলের কর্মীরাও।
কারণ তাদের মধ্যে নির্বাচনকালীন যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার জের এখনো কাটেনি। বরং নির্বাচনপন্থীরা চালকের আসনে বসে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করেছেন। এতে করে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পার্টির মধ্যে।
এছাড়া এরশাদের কথাকেও আর বিশ্বাস করতে পারছেন না তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। তার কোন কথাটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা বোঝা কার সাধ্য! এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মীদের মনে। এসবে প্রভাবিত হচ্ছেন তারা। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো।
ডিসিসি নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন এরশাদ। কিন্তু শনিবার (১৪ মার্চ) উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজের পোস্টার টানাচ্ছিলেন সোহেল নামে এক কর্মী। সোহেলের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এরশাদ বাহাউদ্দিনের নাম ঘোষণা করেছেন। আর আপনি ববি হাজ্জাজের পোস্টার টানাচ্ছেন যে! আপনার প্রার্থী কি মনোনয়ন পাবে?’
জাপার এই কর্মীর ঝটপট জবাব: ‘ভাই, এরশাদের কথার কি ঠিক ঠিকানা আছে! কখন দেখবেন বদলে ফালাইব। এখন একজনের নাম ঘোষণা দিয়ে দেখতাছে পরিস্থিতিটা আসলে কেমন।’
শুধু সোহেল নন, অন্যরাও মনে করেন এরশাদের কথার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এই বিষয়টি অনেক নেতা নিজের স্বার্থে কাজে লাগান। এরশাদ কোনো ঘোষণা দিলে কিংবা কাউকে কোনো পদে বসালে অন্যরা বলে বেড়াতে থাকেন: দেখা যাক কি হয়। কয়েক দিন পরেই বদলে ফেলবে।
এসব কারণে দলের মধ্যে উপদলের সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মীরা হচ্ছেন বিভ্রান্ত।
সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা খোদ এরশাদকেও ভাবিয়ে তুলেছে বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে এরশাদ এবার কঠোর হবেন বলেও আভাস দিয়েছেন তাদের অনেকে। সময় হলেই শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেনে এরশাদ। তিনি নাকি ঘনিষ্ঠজনদের এমন আভাসই দিয়েছেন।