ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইফতার বলতেই খানদানি একটা ব্যাপার থাকে। সেটা হোক হলে কিংবা অন্য কোনো জায়গায়। ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীরা পরিবার ছেড়ে ইফতার করার বেদনা ভুলে যায় বন্ধুদের সাথে একসাথে বসে ইফতারের মাধ্যমে। চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে ঘাসের ওপর পত্রিকা বিছিয়ে বা কোথাও থেকে বড় ছোট পাত্র জোগাড় করে গোল হয়ে বসে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আলাপের পাশাপাশি চলে ইফতারের আয়োজন।
প্রতি বছর রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি থাকলেও এবার করোনা মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য চার মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে ক্লাস, পরীক্ষা চলছে কমবেশি সব বিভাগেই। তাই শিক্ষার্থীরা বাড়িতে না গিয়ে ইফতারের আনন্দ ভাগাভাগি করছেন বন্ধু-বান্ধব, বড় ভাই ছোট ভাইদের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এলেও তারা সবাই একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইফতারে শামিল হন। ক্যাম্পাসে যেসব বন্ধুবান্ধব নিয়ে একসাথে ইফতার করতে দেখা যায় যেখানে ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকে না।
ইফতারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভিড় করেন ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের(টিএসসি) মাঠে। এখানে আসরের পর থেকেই জায়গা দখলের হিড়িক পড়ে যায়, কে আগে বসতে পারে। দুইজন, তিনজন, কিংবা একসাথে ১০ থেকে ২০ জনকে গোল হয়ে ইফতার করতে দেখা যায় বিভিন্ন হলের মাঠে, হলের ছাদে। যে যেখানে পারছে কয়েকজন মিলে বসে যাচ্ছে। রমজানের শিক্ষা ত্যাগ ও সম্প্রীতির বন্ধনের নমুনা ফুটে ওঠার এ যেন এক অপরূপ দৃশ্য। টিএসসির মাঠ ছাড়াও ইফতারের মনমাতানো এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় কার্জন হল প্রাঙ্গণে, সেন্ট্রাল মাঠে, ঐতিহাসিক বটতলা, সবুজ চত্বর, মলচত্বর, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরি প্রাঙ্গণ, মুহসীন হলের ছাদে, সূর্যসেন হলের মাঠ, এফ রহমান হলের মাঠ, কবি জসিম উদ্দিন হলের সামনের প্রাঙ্গণ, মেয়েদের হলের মধ্যে শামসুন্নাহার হল মাঠ, রোকেয়া হল মাঠ, কবি সুফিয়া কামাল হলের মাঠসহ বাকি হলগুলোতেও ইফতারের আয়োজনে সবাই এক হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রতিটা রুমে তো রুমমেটদের সাথে ইফতার আছেই।
বিকেল হতেই উৎসবমুখর পরিবেশে ইফতারের সামগ্রীর জোগান দিতে পুরো ক্যাম্পাসে ইফতারের দোকানে ভরে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে জমজমাট ইফতারের বাজার দেখা যায় হলপাড়ায়। এখানকার বাজারে পুরান ঢাকার ইফতারের বাজারের (চকবাজার) বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের বিশেষ ছোয়া লক্ষ করা যায়। ইফতারের পূর্বমুহূর্তে গ্রামের হাটবাজারের ছাপ ফুটে ওঠে এসব জায়গায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ইফতার হয় সাদামাটা। ইফতারের মেনু তে থাকে মুড়ি, ছোলা, কলা, বেগুনি, চপ, শসা, লেবুর মতো নিতান্তই সামান্য আইটেম। এগুলো ছাড়াও মাঝে মধ্যে খিচুড়ি কিংবা তেহারিও পাওয়া যায় কিছু কিছু জায়গায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনে ও চোখেমুখে একপ্রকার তৃপ্তির সুবাতাস লক্ষ্য করা যায়। সারা দিনের রোজার ক্লান্তি সবার সাথে মিশে ইফতার করার মাধ্যমে নিমেষেই ম্লান হয়ে যায়।
এগুলো ছাড়াও ক্যাম্পাসের ইফতারের আরেকটি সৌন্দর্য হচ্ছে বিভিন্ন অনুষদ, ব্যাচ, বিভাগ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বা জেলা-উপজেলাভিত্তিক সংগঠনের ইফতার মাহফিল। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অডিটোরিয়াম অথবা খোলা মাঠে এই আয়োজন থাকে প্রতিদিনই। এই আয়োজন ঘিরে তৈরি হয় একপ্রকার এলাহী কাণ্ড কারখানা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে এখানে জেলা-উপজেলা ভুলে এক হয়ে যায় নানান শ্রেণিপেশার মানুষ।
টিএসসির মাঠে ইফতার করতে আসা সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদ বলেন, পরিবার ছেড়ে এবারই প্রথম বাইরে রোজা পালন করছি। পরিবারের অভাব বোধটা আসলে এখানে হয়না কখনো। আর মনে হয় প্রতিদিনই যেন ঈদ।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হজরত আলী বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই ইফতার করা আসলেই অনেক সুন্দর ব্যাপার। হাদিসেও সবার একসাথে ইফতারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে সবার মধ্যে মিল-মহব্বত সৃষ্টি হয়, আর রমজানের বরকতে সেটা দীর্ঘস্থায়ীও হয়।