সিলেটে রাতভর সংঘর্ষ, আগুন, হাফেজ নিহত

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


সিলেট: ঘটনাস্থল সিলেটের জৈন্তাপুরের হরিপুর। টানা ১০ ঘণ্টার দফায় দফায় সংঘর্ষ। রাতের আঁধারে কী হচ্ছে বুঝা মুশকিল। হাজার হাজার মানুষ জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষে। বৃষ্টির মতো ছোড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও আসছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ সহ ১৭ পরগণার সালিশ ব্যক্তিরা ঝুঁকি নিয়ে সংঘর্ষের ভেতরে ঢুকলেন। কেউ মানলো না তাদের কথা।

সকালে মধ্যস্থতাকারী হাফেজ মাওলানা সালেহ আহমদ নিহত হওয়ার পর বাজার দখলে নেন শ্যামপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদের লোকজন। এ সময় তারা হেমু হাউদপাড়া গ্রামের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ছাড়াও লুটপাট চালায় তারা। এক পর্যায়ে সকাল ৯ টার দিকে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা বাজারে অবস্থান নিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে- গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্তও উভয়পক্ষ ছিল মুখোমুখি। হরিপুর বাজার। এক নামেই এই বাজারের পরিচিতি সিলেটজুড়ে। মূলত এই বাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে এবারের সংঘর্ষ। এর এক দিকে রয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুর রশিদ ও অপরদিকে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রফিক আহমদ ও তার লোকজন। গত নির্বাচনের পর থেকে বাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে মূলত আব্দুর রশিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান রফিক ও জাকারিয়া অংশের মধ্যে বিরোধ চলছে। সম্প্রতি পশুর বাজারের ইজারা নিয়ে নতুন করে তাদের মধ্যে বিরোধ আরও চাঙ্গা হয়। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- হরিপুরের পশুরহাট হচ্ছে পূর্ব সিলেটের অন্যতম পশুরহাট। এই হাটের ইজারা নিয়ে এলাকার মানুষ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন হরিপুর মাদ্রাসার পক্ষ থেকে এবার ইজারায় অংশ নেওয়া হবে। এর লভ্যাংশ মাদ্রাসা, মসজিদেও যাবে। এতে সবাই এক মত হলেও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল রশিদ এই সিদ্বান্ত মানেননি। তিনি দরবস্থ এলাকার এক ব্যবসায়ীকে দিয়ে ইজারায় অংশ নেন। ফলে বাজার ইজারা নিয়ে বিরোধের মধ্যে চলে আসে বাজারের পশুর হাটের পার্শ্ববর্তী স’মিলের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। স’মিলের মালিক হেমু দাউদপাড়ার কানাডা প্রবাসী হাজী নুরুল হক। তার চাচাতো ভাই ইমতিয়াজ আহমদ ও তার ভাইরা এই স’মিল দেখাশোনা করেন। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ ক্রয়সূত্রে স’মিলের ভূমিও তার বলে দাবি করে বসেন। এ নিয়েও কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। আব্দুর রশিদ দাবি করেন- কানাডা প্রবাসী মালিক নুরুল হক তার কাছে ওই জমি বিক্রি করেছেন। অন্যরা জোরপূর্বকভাবে ওই সম্পত্তি দখলে রেখেছে। হরিপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- রোববার মধ্যরাতের দিকে সাবেক চেয়ারম্যান রশিদ আহমদের পক্ষের লোকজন বাজারে থাকা স’মিলের জায়গা দখল করতে যান। এ সময় বাধা দেন ইমতিয়াজ আহমদ সহ তাদের পক্ষের লোকজন। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষকালে দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। সিলেট-তামাবিল সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। রাতে উভয়পক্ষের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশ সহ ১৭ পরগণার সালিশ ব্যক্তিরা চেষ্টা চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। তবে- স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। তারা জানিয়েছেন- সংঘর্ষের শুরুতে ব্যবসায়ীরা পুলিশের সহযোগিতা চাইলেও পাননি। কম সংখ্যক পুলিশ আসার কারণে ভয়ে তারা বাজারের ভেতরে ঢুকেনি। পরে বড় আকারে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে আর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। রাতভর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে রাতেই সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে- স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা রফিক ও জাকারিয়া পক্ষের লোকজন দাবি করেছেন- ভোরে তারা বাড়িতে চলে আসার পর সাবেক চেয়ারম্যান হাজারো মানুষকে নিয়ে কর্তৃত্ব নিতে বাজারে প্রবেশ করে। এ সময় বাজারে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালায়। এক পর্যায়ে আগুনও ধরিয়ে দেয়। এ খবর পেয়ে ফের বাজারমুখী হতে শুরু হতে শুরু করেন হেমু হাউদপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা। এ দৃশ্য দেখে স্থানীয় হেমু মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ক্বাসেমী সহ স্থানীয়রা কিছু লোক মধ্যস্থতা করতে আসেন। এক পর্যায়ে সকাল ৭ টার দিকে তাদের উপরও বিচ্ছিন্ন হামলা করা হয়। এই হামলায় ঘটনাস্থলেই হয়েছেন হাফিজ মাওলানা সালেহ আহমদ। তিনি স্থানীয় ভাটপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এদিকে- বিবদমান উভয়পক্ষ হত্যাকান্ডের জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে। এ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা চলছে ভাটপাড়া গ্রামেও। নিহত আত্মীয় স্বজনরা ঘটনার জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এদিকে- হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশ, র‌্যাবের কয়েকটি টিম বাজারে প্রবেশ করে। তারা লাঠিচার্জ চালিয়ে বিবদমান পক্ষকে বাজার থেকে সরিয়ে দেয়। সকাল ১০ টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। জৈন্তাপুর উপজেলার ওসি গোলাম দস্তগীর জানিয়েছেন- সকালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এরপর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য লাশ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন- পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এদিকে- সংঘর্ষ থামার পর গতকাল সকাল থেকে সিলেট-তামাবিল সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। দুপুরে সিলেটের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হরিপুর বাজার পরিদর্শন করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *