পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী তাদের ক্ষমতার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে বাধ্য হয়েছেন ক্ষমতা ছাড়তে। ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছরের মাথায় পদ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও।
দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগে ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো পার্লামেন্টে যে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে, তার ভোটাভুটি হওয়া কথা রোববার (৩ এপ্রিল)। কিন্তু সেই ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান মিত্র এমকিউএম বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নড়বড়ে হয়ে গেছে ইমরানের গদি। তীব্র হয়েছে তার পদত্যাগের দাবিও।
এমন অচলাবস্থার মধ্যেই পাকিস্তানের বিরোধীদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করার অভিযোগ এনেছেন ইমরান খান। তার অভিযোগ, ওয়াশিংটন তাকে পদচ্যুত করতে চাইছে কারণ তিনি একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছেন এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি রাশিয়া সফর করেছেন।
খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই সরকার বলছে, বিদেশি একটি মিশনের কাছ থেকে পাওয়া এক কূটনৈতিক নথির মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের এ তথ্য সামনে এসেছে। যেখানে লেখা ছিল, ‘ইমরান খান যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আপনারা সমস্যার সম্মুখীন হবেন।’ যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।
ক্ষমতা ধরে রাখতে ৩৪২ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অন্তত ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন ধরে রাখতে হবে ইমরান খানকে। কিন্তু ডনসহ স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, বিরোধীরা এরই মধ্যে ১৭২ জন সদস্যের সমর্থন পেয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পরপরই পাকিস্তানে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এর এক দশকের বেশি সময় পর ১৯৫৮ সালে জারি করা হয় সামরিক আইন। ১৩ বছর ধরে সামরিক আইনে চলার পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এরপর ১৯৭৩ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় সংবিধান পাসের পর তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু একই বছর তিনি জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৮৮ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়া-উল-হকের মৃত্যুর পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তার ক্ষমতা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র তিন বছর। ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বেনজির। তার স্থলাভিষিক্ত হন পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) নওয়াজ শরিফ। কিন্তু ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চাপে তাকেও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হয়।
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়েও পিপিপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আবারও দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান বেনজির ভুট্টো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে বেনজিরকে আবারও ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরবর্তী নির্বাচনে জয় পায় পিএমএল-এন। আবারও ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত মোশাররফের শাসনামলে তিন জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন- মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি, চৌধুরী সুজাত ও শওকত আজিজ।
এর মধ্যে ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাফরুল্লাহ জামালি, ২০০৪ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চৌধুরী সুজাত এবং ২০০৪ সালের আগস্টের পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন শওকত আজিজ। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পিপিপি জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইউসুফ রাজা গিলানি। কিন্তু ২০১২ সালে আদালত অবমাননার এক মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সরিয়ে দেওয়া হয়। গিলানির বাকি মেয়াদ পূর্ণ করেন রাজা পারভেজ আশরাফ।
এরপর ২০১৩ সালে পুনরায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু দুর্নীতি মামলার কারণে ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ করেন। নওয়াজের বাকি মেয়াদ পূর্ণ করেন শহীদ খাকান আব্বাসি। সবশেষ ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান খান। দায়িত্ব নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধেও ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ।
যেভাবে রাজনীতিতে ইমরান
সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার এবং পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কও ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ২০০৫ এবং ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন ইমরান।
লাহোরে জন্মগ্রহণ করা ইমরানের উচ্চ-মধ্যবিত্ত পৈতৃক পরিবার মূলত পশতুন জাতিসত্তার এবং নিয়াজি উপজাতির অন্তর্গত। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল গ্রামার স্কুল ওরচেস্টারে পড়াশোনার পাশাপাশি সেখান থেকে ক্রিকেটের দীক্ষাও নেন ইমরান খান। ১৯৭২ সালে অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেন দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে। স্নাতক হন ১৯৭৫ সালে।
১৯৯২ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করেন ইমরান খান। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন দলটির। এরপর ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পিটিআইয়ের প্রার্থী হিসাবে দুটি নির্বাচনী এলাকা- মিয়ানওয়ালি এবং লাহোর থেকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন এবং উভয় আসনেই পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রার্থীদের কাছে হেরে যান।
২০০২ সালের অক্টোবরে আবারও পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ইমরান এবং তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে জোট গঠনের প্রস্তুতিও নেন। সেবার মিয়ানওয়ালি থেকে নির্বাচিত হন তিনি। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর সরকারের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে লাহোরে লাখ লাখ মানুষের সামনে ভাষণ দেন খান। একই বছর করাচিতেও বিশাল এক জনসমাবেশ করেন ইমরান।
এরপর থেকে তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলগুলোর জন্য সত্যিকারের হুমকি হয়ে ওঠেন। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে তিক্ত দ্বন্দ্বে জড়াতে শুরু করেন ইমরান খান এবং নওয়াজ শরীফ।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বান্নু, ইসলামাবাদ, মিয়ানওয়ালি, লাহোর এবং পূর্ব করাচি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ইমরান। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ২৭০টি আসনের মধ্যে পিটিআই মোট ১১৬টিতে জয়লাভ করেছে বলে ওই বছরের ২৮ জুলাই ঘোষণা দেয় পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন।
এরপর বিজয়ী ভাষণে ইমরান খান তার ভবিষ্যৎ সরকারের নীতির রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার অনুপ্রেরণা হলো মদিনার প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। বৈদেশিক নীতিতে, তিনি চীনের প্রশংসা করেন এবং আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার আশা প্রকাশ করেন।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেছে দেশটির বিরোধী জোট। বিরোধীদের এমন পদক্ষেপ সফল হলে পাকিস্তানি রাজনীতি একটি অশুভ মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। এ ছাড়া ইমরান খানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারই দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের সাংসদদের একাংশ। সব মিলিয়ে উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটির রাজনীতি।