দেশীয় আখ থেকে উৎপাদিত চিনির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। সাদা বা ঘনচিনির চেয়ে পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় এ চিনির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আখের চিনি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। তবে বেসরকারিভাবে বাজারে আখের চিনি বিক্রি করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে বিএসএফআইসির আখের চিনি বাজারে মেলা কঠিন।
রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, বাড্ডা, রামপুরাসহ একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে দোকানগুলোতে নেই আখের চিনি। শেষ কবে আখের চিনি বিক্রির জন্য এনেছিলেন মনে করতে পারেননি অনেক ব্যবসায়ী। তবে এ চিনির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
গৃহিণী মিফতাফ উন আলিয়া মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের মুসলিম বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে আখের চিনি খুঁজেছেন। চিনি না পেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে জানিয়েছেন অভিযোগ। তব মেলেনি এ চিনি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, রিফাইনিং (পরিশোধিত) পদ্ধতিতে চিনি তৈরির সময় ভিটামিনসহ উপকারী পুষ্টি উপাদান দূর হয়ে যায়। এই চিনি মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অন্যদিকে আখের চিনি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। গত জানুয়ারি মাসে কারওয়ান বাজার থেকে পাঁচ কেজি চিনি এনেছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখছি কোথাও এই চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের স্বার্থেও আখের চিনি কেনা উচিত বলে মনে করেন এই গৃহিণী। তিনি বলেন, আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য সবাইকে লাল চিনি খেতে যেমন উৎসাহিত করতে হবে তেমনি চিনিকলের শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন আর অসচ্ছলতার হাত থেকে রক্ষায় এই চিনির বিক্রি বাড়াতে হবে।
চাহিদা থাকলেও বাজারে নেই আখের চিনি!
হাসিব মামুন নামে এক সরকারি কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এই চিনি খুবই উপকারী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী জোগানের ব্যবস্থা নেই। এই চিনি কোথায় পাওয়া যাবে কেউ জানে না। বাড্ডা বাজারের ব্যবসায়ী রাশেদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, চিনি দোকানে কেউ এসে দিয়ে যায় না। বিএসএফআইসির হেড অফিস থেকে আনতে হয়। এতে প্রতি কেজি আমাদের কেনাই ৭৫ টাকার উপরে। লাভ করবো কী? কেননা সাদা চিনি তো ৮০ থেকে ৮২ টাকা।
দোকান ছাড়াও স্বপ্ন, মীনা বাজারের মতো চেইনশপেও মিলছে না আখের চিনি। এছাড়া চালডালসহ বেশ কিছু ই-কমার্স ওয়েবসাইটেও স্টক আউট দেখাচ্ছে এ চিনি।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের এক পরীক্ষায় দেখা যায়, আমদানি করা পরিশোধিত এবং দেশে উৎপাদিত পরিশোধিত চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আখ থেকে উৎপাদিত দেশি চিনিতে ক্যালসিয়ামের মাত্রা ১৬০ দশমিক ৩২, যা পরিশোধিত চিনিতে ১ দশমিক ৫৬ থেকে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পটাশিয়াম দেশি চিনিতে ১৪২ দশমিক ৯ শতাংশ, পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৩২ থেকে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফসফরাস দেশি চিনিতে ২ দশমিক ৫ থেকে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ আর পরিশোধিত চিনিতে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আয়রন দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ৪২ থেকে ৬ শতাংশ আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। ম্যাগনেশিয়াম দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ৬৬ থেকে ১ দশমিক ২১ শতাংশ। সোডিয়াম দেশি চিনিতে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ আর পরিশোধিত চিনিতে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
চাহিদা থাকলেও বাজারে নেই আখের চিনি!
‘পরিশোধিত চিনিতে মিষ্টির কোনো অ্যাসেনসিয়াল নিউট্রিয়েন্ট নেই এবং কৃত্রিম উপায়ে মিষ্টতা বাড়ানো হয়। যে কারণে এই চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পরিশোধিত চিনি ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিসের মাত্রা বাড়ায়। এই চিনি দিয়েই তৈরি হচ্ছে মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার (চকলেট, আইসক্রিম, কনডেন্সড মিল্ক, বেকারি ও বেভারেজ দ্রব্য, এনার্জি ড্রিংকস, স্পোর্ট ড্রিংকস ইত্যাদি)। অনেকে আবার আখের চিনির বিকল্প হিসেবে আর্টিফিসিয়াল সুইটেটনার্স বা কৃত্রিম চিনি যেমন- স্যাকারিন, সোডিয়াম সাইক্লামেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম, সালফেট, সুক্রোল ব্যবহার করেন। এগুলো খেয়ে বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা প্রায়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই চিনি তৈরিতে ব্যবহার হয় সোডা ও কপি সুইটেনার্স যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই সোডা আর পরিশোধিত চিনি ক্যানসারের জীবাণু বৃদ্ধির জন্য দায়ী।’ (জাতীয় পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এম এইচ আখতারুজ্জামানের একটি নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত)
চিনির চাহিদার কথা স্বীকার করে বিএসএফআইসি বলছে, চিনির উৎপাদন কমে যাওয়ায় তারা বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে চিনিকলগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) পরিচালক (উৎপাদন ও প্রকৌশল) এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাহিদা আছে আমরাও জানি। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমরা বাজারে পর্যাপ্ত চিনি দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, মূলত কাঁচামালের অভাবে চিনির উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়া বর্তমানে চালু চিনিকলগুলো অনেক পুরোনো, অবচয় খুব বেশি। সেখানে ইচ্ছে থাকলেও বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদনে ধাক্কার আরেক বড় কারণ শেষ ২০২০ সালে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া। চিনিকলগুলোর লোকসানের বোঝা কমাতে ওই সময় বিএসএফআইসি এসব চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় থেকে ১৫টির মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ হয়েছে।