বাংলাদেশ। আমার মাতৃভূমি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করি আমরা। লাখো শহীদের রক্ত ও মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পাতাকার বয়স এখন ৫১। মুক্তিযদ্ধের সময় জন্ম নেয়া শিশুর বয়স এখন ৫১। অর্ধ বয়সী সেই শিশুর অবয়বে এখন বয়সের ছাপ। অযত্ন আর অবহেলায় থাকা ৫১ বছরের সেই শিশুদের অনেককে দেখলে চেনার উপায় নেই তার বয়স ৫১। মনে হবে ৮০/৯০। ব্যতিক্রমও আছে। ৫১ বছরের একজন বাংলাদেশী নাগরিক তার দেশের স্বাধীনতার স্বাদ কতটুকু পেয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন এসে গেছে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এখানে সকল নাগরিকেরা স্বাধীন। রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীনতা সহ সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর বয়সে নাগরিকেরা কতটুকু তাদের মৌলিক অধিকার ভোগ করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন দিন দিন বাড়ছে। ৫১ বছরে শ্রমজীবী ও পরজীবী মানুষের মধ্যে দ্বন্ধই তৈরী হয়নি বরং বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় পরজীবীরা উত্তীর্ণ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। মেধা আর মেধাহীন মানুষের মধ্যেও কোন প্রতিযোগতিা নেই। কারণ স্বচ্ছল মানুষ হতে হলে মেধা তেমন কোন কাজে আসছে না। মেধাহীনরাই মেধাবীদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। অনেক জায়গায় মেধাহীন কর্তাব্যাক্তির অধীন মেধাবীরা চাকরের কাজ করছেন। সাম্য মানবতা আর ভোট ও ভাতের অধিকার এখন সরল পথে নেই। বাাঁকা পথে চলে গেছে। মানুষ একদিকে আর নাগরিকেরা অন্য দিকে চলে যাচ্ছেন। মানুষ ও নাগরিকদের এই পথভুলা গতি গন্তব্যে পৌঁছাবে কবে তা নিয়ে প্রশ্ন বিস্তর।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের শতকরা ৬৬ ভাগ মানুষ শিক্ষিত বেকার। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪২ ভাগ দরিদ্র। বিবিএসের খানা জরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময়ে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০০৮ সালের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। ২০১০ সালে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে এবং উল্লিখিত সময়ের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পর ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশে এখনও ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার। এই হিসাবে দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি সাড়ে ১২ লাখ। সরকারি হিসাবে এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০০ সালে কোন কোন জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষনাও করা হয়েছে। এই হারে সাক্ষরতা বাড়তে থাকলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে আরও ২৭ বছর লাগবে।
গণতন্ত্র আমাদের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হলো গণতন্ত্র। ৫১ বছর বয়সে আমরা কতটুকু গণতন্ত্র পেয়েছি, তা সবাই জানি। ৫১ বছরের মধ্যবয়সী মানুষ শিশুকালের ইতিহাস স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। ৫১ বছর বয়সী মানুষ শিশুকাল ও দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছেন না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সকল সরকার নিজেদের মত করে ইতিহাস রচনা করে। বাংলাদেশের অভিন্ন ইতিহাস রচনা না হওয়ায় বার বার ভিন্নতা চলে আসছে। ইতিহাসেই শুধু নয়, গণতন্ত্রেও ভিন্নতা। কবে গণতন্ত্র ছিল তাও ভুলে যাই আমরা। স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও সংবিধানে আছে জনগন সকল ক্ষমতার মালিক। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। জোর করে ক্ষমতা দখল ও জোর করে ক্ষমতায় যাওয়া আসার সংস্কৃতি প্রায় স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা দখলের কারণে বা ক্ষমতায় জোরপূর্বক যাওয়া-আসার কারণে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয় হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মালিকানা খর্ব হওয়ায় নাগরিকেরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৫১ বছরে অসংখ্যবার সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আন্দোলন করা হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার পর আবার ওই সকল কথিত স্বৈরশাষকদের দিয়ে সরকারও পরিচালনা করা হয়েছে। দেশ বিরোধী দলকে প্রতিষ্ঠাও করা হয়েছে আবার সরকারের ভাগও দেয়া হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রে এ যেন এক বোকার আলামত। সাধারণ মানুষ পাগলের মত রাস্তায় নেমে যা অর্জন করেছেন তার মধ্যে বেশীর ভাগই রক্ত আর লাশ। এই অবস্থা চলতে থাকলে রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্থায়ীভাবে হারানোর ভয় এখন নাগরিকদের নিত্যদিনের শংকা।
রাজনীতি বাংলাদেশর জন্ম দিয়েছে এতে সন্দেহ নাই। পাকিস্তানের হাত থেকে যারা দেশকে স্বাধীন করেছেন তারা প্রায় সকলেই রাজনীতিবিদ। তাই রাজনীতি দেশ চালাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশ কি রাজনীতিবিদদের হাতে আছে! এটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশ যদি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকত, তবে ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীদের হাহাকার থাকত না। প্রায় সকল রাজনৈতিক দলে ত্যাগী কর্মীদের হাহাকার নিত্যদিনের ঘটনা। রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি না থাকায় রাজনীতিও কোনঠাসা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ, নাগরিক ও রাজনীতিবিদ তিন পথে চলমান এখন। কেউ কারো দ্বার দ্বারে না, আজ কাল।
বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি বলছে, কেউ ভালো নেই। ভালো চলছে না দেশ। মানুষে মানুষে নেই কোন মিল। প্রতিযোগিতার মাত্রা এত বেশী হয়ে যাচ্ছে যে, আমরা সকলেই প্রতিযোগী হয়ে যাচ্ছি। রেফারীর সংকট পড়ছে দিন দিন। এই অবস্থা চলতে থাকলে শান্তি প্রতিষ্ঠার খেলাটা কিভাবে হবে সেটাও প্রশ্ন। খেলাটাই যদি না হয়, তবে কে বিজয়ী, আর কে পরাজিত, তাও জানা যাবে না। খেলা শেষ কেন, খেলা হওয়ারই সম্ভাবনা নেই। ফলে মানুষ-অমানুষের খেলা কবে হবে তা জানা কঠিন।
আমরা চাই, বাংলাদেশ লড়াই করে জন্ম নিয়েছে। লড়াই করেই বাঁচবে ইনশাল্লাহ। সে লড়াই দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, অমানুষের বিরুদ্ধে, খারাপের বিরুদ্ধে, অগনতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে। এই লড়াই সফলভাবে শেষ করতে হলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দলমত নির্বিশেষে সকলকে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। চেতনা বিক্রি বন্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সুন্দর নিরাপদ ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলতে সাধারণ মানুষকে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিক ও ভালো মানুষগুলোকে এক পথে চলতে হবে, এক অভিন্ন উদ্দেশ্যে, এক গন্তব্যে। না হয়, সব হারিয়ে হাতে হারিকেন নিয়ে ঘুরতে হবে সারা জীবন। আর ৫১ নয় ১০০ বছরেও আমরা সাবালক হতে পারবো কি না! সন্দেহ থেকেই যাবে।
লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
তাং ২৬ মার্চ ২০২২