ঢাকা: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে বিভিন্ন বহিরাগত জাতি ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে। প্রথমে গ্রিক, এরপর শক-পার্থিয়ান এবং এক পর্যায়ে আগমন ঘটে কুষাণদের।
ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি কুষাণরা (চীনের একটি জাতি) বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন কুষাণ সম্রাটের নানা প্রকৃতির প্রাপ্ত মুদ্রার সংখ্যা ও গঠন প্রকৃতি দেখে তারা এ ধারণা করছেন।
বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে ২১৬টির মতো কুষাণ মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে। মুদ্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে-প্রকৃত কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা, কুষাণ অনুকৃতি স্বর্ণমুদ্রা ও কুষাণ তাম্রমুদ্রা। এ মুদ্রাগুলো ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট, সাভার, চাঁদপুর, রাজশাহী, নোয়াখালি, গাজীপুর, ফরিদপুর, মহাস্থানগড় এবং বগুড়ার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গিয়েছে।
কুষাণ মুদ্রার মূখ্যদিকে রয়েছে বিভিন্ন কুষাণ সম্রাটের প্রতিকৃতি। আর গৌণদিকে রয়েছে প্রাচীন গ্রিস, মেসোপটেমিয়া, পারস্য ও প্রাচীন ভারতীয় দেব-দেবীর প্রতিকৃতি।
গবেষকদের মতে, কুষাণ যুগে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। মধ্য এশিয়া থেকে ঘোড়া আমদানি করা হত, তারপর তা পূর্ব এশিয়ায় রফতানি করা হত। এছাড়া ভারতবর্ষ থেকে ব্যাপকভাবে পূর্ব এশিয়ায় চাল ও সুতিবস্ত্র রফতানি করা হত। বাংলার বন্দরগুলো এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এ বহি:বাণিজ্যের সূত্র ধরে বাংলায় কুষাণ মুদ্রা এসেছিল। বাংলার লোকেরা কুষাণ মুদ্রাকে নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে। প্রায় ২০০ বছর ধরে এ মুদ্রাগুলো প্রচলিত ছিল।
তাদের মতে, কুষাণ যুগে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিল এটি প্রমাণিত। তবে কুষাণরা বাংলা শাসন করেছেন এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তারপরও কুষাণদের শাসন নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে বাংলায় কুষাণ অধিকারের পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রকৃত কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা: জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে কণিষ্ক, হুবিষ্ক, বাসুদেব ও তৃতীয় কণিষ্কের মোট ৪২ প্রকৃত কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। এরমধ্যে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের ৭ রকমের ১৮টি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে।
এ মুদ্রাগুলোর মূখ্যদিক একই রকম। মুদ্রার দণ্ডায়মান রাজার প্রতিকৃতিতে এক হাতে বর্শা, অপর হাতে বেদীতে অর্ঘ্য প্রদানরত। রাজার মুখে দাড়ি, লম্বা কোট ও ট্রাউজার পরিহিত। গোলাকার মুদ্রার চারিদিকে গ্রিক অক্ষরে লেখা ‘শাও নানো শাও কানেষ্কি কুষাণো’। এর অর্থ শাহান শাহ কুষাণ কণিষ্ক।
এ মুদ্রার গৌণদিকে ৭ রকমের দেব-দেবীর প্রতিকৃতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মুদ্রার গৌণদিক ভিন্ন রকম। মুদ্রায় অঙ্কিত দেব-দেবীর মধ্যে রয়েছে- মাও, মিরো, ননা, ননাশাও, ওয়েশো, অর্দক্ষো ও মানাওবাগো। দেব-দেবীর প্রতিকৃতির পাশে গ্রিক অক্ষরে তাদের নাম উৎকীর্ণ রয়েছে।
হুবিষ্কের স্বর্ণমুদ্রা: জাদুঘরে কুষাণ সম্রাট হুবিষ্কের ৮ রকমের ১৮টি প্রকৃত স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। মুদ্রার মূখ্যদিকে হুবিষ্কের প্রতিকৃতি রয়েছে। রাজা অলংকৃত পোশাক পরিহিত, মাথায় রাজমুকুট, এক হাতে রাজদণ্ড, অপর হাতে ধৃত বর্শা। গোলাকার মুদ্রার রাজ প্রতিকৃতির চারিদিকে গ্রিক অক্ষরে সম্রাট হুবিষ্কের অভিধা রয়েছে ‘শাও নানো শাও হুবেষ্কি কুষাণো’। এর অর্থ শাহান শাহ বা রাজাধিরাজ কুষাণ হুবিষ্ক।
মুদ্রার গৌণদিকে প্রাচীন পারস্য, ভারত, মেসোপটেমিয়া ও গ্রীক দেব-দেবীর প্রতিকৃতি রয়েছে। এরমধ্যে আছে মাও, মিরো, অর্দক্ষো, অথশো, মানাওবাগো, শিব, ফারো দেব-দেবীর প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির পাশে গ্রিক অক্ষরে তাদের নাম উৎকীর্ণ।
তৃতীয় কণিষ্কের স্বর্ণমুদ্রা: জাদুঘরে একটি তৃতীয় কণিষ্কের একটি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। মুদ্রার মূখ্যদিকে দণ্ডায়মান রাজার প্রতিকৃতি। কোমরে তরবারি। রাজার এক হাতে ত্রিশুল, অপর হাতে বেদীতে অর্ঘ্য প্রদানরত। গ্রিক লিপিতে ‘শাও নানো শাও’ শব্দ উৎকীর্ণ। রাজ প্রতিকৃতির একদিকে ব্রাক্ষ্মী অক্ষরে লেখা ‘চু’ এবং দু’ পায়ের মাঝে ব্রাক্ষ্মী অক্ষরে লেখা ‘বা’। মুদ্রাটির গৌণদিকে সিংহাসনে উপবিষ্ট দেবী অর্দক্ষো। তিনি অহুরামাজদার বোন। প্রাচীন পারস্যের ধন ও সৌভাগ্যের দেবী।
বাসুদেবের স্বর্ণমুদ্রা: জাদুঘরে বাসুদেবের ৫টি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। মুদ্রাগুলোর মুখ্য ও গৌণদিক একই রকম। মূখ্যদিকে দণ্ডায়মান রাজার প্রতিকৃতি। রাজার এক হাতে ত্রিশুল, অপর হাতে বেদীতে অর্ঘ্য প্রদারনত। কোমরে বদ্ধ তরবারি। মাথায় রাজমুকুট, লম্বা কোর্ট ও ট্রাউজার পরিহিত। মুদ্রায় গ্রিক অক্ষরে লেখা ‘শাও নানো শাও বাজোদেও কুষাণো’। যার অর্থ রাজাধিরাজ কুষাণ বাসুদেব। এ মুদ্রার গৌণদিকে নন্দীর পাশে দণ্ডায়মান শিবের প্রতিকৃতি। শিবের এক হাতে ত্রিশুল, অপর হাতে ফাঁস। দেবতার পাশে গ্রিক অক্ষরে উৎকীর্ণ ওয়েশো (শিব)।
কুষাণ অনুকৃতি স্বর্ণমুদ্রা: জাদুঘরে ৩২টি কুষাণ অনুকৃতি স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। এরমধ্যে ২৬টি কণিষ্কের ইমিটেশন স্বর্ণমুদ্রা, ৫টি হবিষ্কের এবং একটি বাসুদেবের। এসব মুদ্রার মুখ্যদিকে কুষাণ সম্রাটদের প্রতিকৃতি এবং গৌণদিকে কুষাণ দেবী অর্দক্ষো অথবা ননার প্রতিকৃতি।
কুষাণ অনুকৃতির মুদ্রাগুলোতে অক্ষর সদৃশ দেখা যায় কিন্তু এসব অক্ষর কোন অর্থ বহন করে না। এর কারণ হলো বাংলার যেসব পাটাশিল্পী কুষাণ মুদ্রার অনুকৃতি তৈরি করেছিলেন, তারা গ্রিক ভাষা বা লিপির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। মুদ্রাগুলোতে সম্রাট ও দেব-দেবীর প্রতিকৃতিও সঠিক হয়নি।
কুষাণ তাম্রমুদ্রা: জাদুঘরে ১৪২টি কুষাণ তাম্রমুদ্রা রয়েছে। এ মুদ্রাগুলোর বেশীরভাগ কণিষ্কের। এছাড়াও বিম কদফিসেস, হুবিষ্ক ও বাসুদেবের তাম্রমুদ্রাও রয়েছে। মুদ্রায় উৎকীর্ণ গ্রিকলিপি অস্পষ্ট ও ক্ষয়ধরা। সম্রাটের প্রতিকৃতি দেখে চেনা যায়। তবে বেশিরভাগ তাম্রমুদ্রার গৌণদিকের দেব-দেবীর প্রতিকৃতিগুলো অস্পষ্ট। এ মুদ্রাগুলো বাংলায় স্থানীয়ভাবে ইস্যু করা হয়েছিল এবং কুষাণযুগে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল।
কুষাণ মুদ্রা নিয়ে মঙ্গলবার (১০ মার্চ) জাতীয় জাদুঘরে ‘অপ্রকাশিত কুষাণ মুদ্রা’ শীর্ষক একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেহেতু এতোগুলো কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গেছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যেতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে মুদ্রাগুলো এসেছে। এ সময় বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিল।
তিনি বলেন, কুষাণ বাংলা শাসন করেছে কি না এটি এখন নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আর এক অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মুদ্রগুলোতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সম্রাটের ও ধর্মীয় প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় সে সময়ও ধর্মীয় বিশ্বাস অব্যাহত ছিল।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট’র অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, কুষাণ যুগে ইন্দ্রো-রোমান লেনদেন খুব উচুতে ছিল। লেনদেন সংক্রান্ত কারণে মুদ্রাগুলো বাংলাতে আসতে পারে।
জাদুঘরে সংরক্ষিত মুদ্রাগুলোর প্রকৃতি নির্ণয় করেছেন জাতীয় জাদুঘরের সহকারী কীপার ড. শরিফুল ইসলাম।
শরিফুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিকদের মধ্যে সাধারণ ধারণা তাম্রলিপি বন্দরের পতনের পর ৭ম শতকে সমতট-হরিকেল বন্দরের বিকাশ ঘটে। এই ধারণা সঠিক না। এসব মুদ্রার (কুষাণ মুদ্রা) ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় তাম্রলিপি বন্দরের পাশাপাশি খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে সমতট, হরিকেল ও কোটালিপাড়া বন্দর বহি:বাণিজ্যে সক্রিয় ছিল।
তিনি বলেন, সাভারের সন্দিপ গ্রাম থেকে কুষাণ মুদ্রা প্রাপ্তি প্রমাণ করে কুষাণ যুগে সাভার গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। কুষাণ যুগে মহাস্থানগড়ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মহাস্থান থেকে কুষাণমুদ্রা প্রাপ্তি ও মহাস্থান সীলগুলো বাংলায় তারই প্রমাণ বহন করে। মহাস্থান থেকে পাওয়া শিলায় ব্রাক্ষ্মী-খরোষ্টি মিশ্র লিপি রয়েছে।