এশিয়ার বৃহত্তম মিষ্টি পানির কৃত্রিম হ্রদ রাঙামাটির ‘কাপ্তাই লেক’। আয়তনে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। জেলা সদরের সঙ্গে ১০ উপজেলার অন্তত ৬টিরই যোগাযোগের মাধ্যম এই হ্রদ। স্থানীয়দের জীবিকা নির্বাহ হয় কাপ্তাইয়ের জলকে ঘিরেই। তবু হ্রদের দেশে পাহাড়ের মানুষের পানির কষ্টই বেশি!
এমনই এক বাস্তবতায় সারাবিশ্বের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পানি দিবস ২০২২’। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘ভূগর্ভস্থ পানি : অদৃশ্য সম্পদ, দৃশ্যমান প্রভাব’।
শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নলকূপে পানি না আসা এবং ঝিরি ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় পানির সংকট দেখা দেয়। জনবসতি বৃদ্ধি, পাহাড় ধসের কারণে পানির উৎস কমে গেছে। এ ছাড়া নির্বিচারে বন উজাড় ও বৃক্ষনিধনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমশ পানির উৎস হারাচ্ছে। পাহাড়ে পানির সংকট শুরু হয় মূলত শীত মৌসুমে। ডিসেম্বর থেকে মে- এই সময়টাতে শুকিয়ে যায় সেখানকার সব ছড়া, ঝরনা ও কুয়া। ফলে বর্ষার আগ পর্যন্ত সংকট থাকে পানীয় জল আর গৃহস্থালির ধোয়ামোছাসহ রোজকার ব্যবহার্য পানির। আবার বর্ষায় ছড়া, ঝরনা ও কুয়াগুলো টইটুম্বুর থাকলেও অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ঘোলা হয়ে যায় এসবের জল; তা পান ও ব্যবহার নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে।
সমতলে পানীয় জলের জন্য ৫০টি বাড়ি নিয়ে একটি নলকূপ স্থাপনের সরকারি নিয়ম থাকলেও পাহাড়ে তা সম্ভব নয়। এখানে ৩০টি বাড়ির প্রয়োজন পরে। আবার পাথুরে এলাকা কিংবা মাটির গভীরে পাথর পাওয়া গেলে নলকূপ স্থাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে। তাদের ভরসা পাহাড়ি ছড়া-ঝরনা বা ছোট খালের পাশে তৈরি কুয়ার জল। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। আয়তন ৬ হাজার ১১৬ দশমিক ১৩ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু সে অনুপাতে লোকসংখ্যা তুলনামূলক কম, ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থার কারণে সমতল জেলার চাইতে ভিন্ন এখানকার ভূপ্রকৃতি। সমতলে পাড়া-মহল্লায় মানুষের যেভাবে ঘনবসতি চোখে পড়ে, পাহাড়ে তেমন নেই। অনেকটাই বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করেন এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা।
রাঙামাটির সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন সাজেক। ৬০৭ বর্গমাইলের এ ইউনিয়নে গ্রামের সংখ্যা ১৫১টি। লোকসংখ্যা ২৫ হাজার ৬৭ জন। এ চিত্রটিই সেখানকার মানুষের বসতি স্থাপনের একটি ধারণা দিতে পারে। তবে সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বিশ্বজিত চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব গণনায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করেন সাজেকে। যাদের ৮০ শতাংশই পানির সংকটে ভোগেন শুকনো মৌসুমে। তখন পাহাড়ি ঝিরি ও ঝরনা শুকিয়ে যায়।’ সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল রয়েছে পানির সরবরাহ। পাহাড়ি নারীরা ছড়া, ঝরনা কিংবা কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করেন। এ জন্য প্রতিদিনই তাদের ৩-৪ কিলোমিটার খাড়াই পথ হেঁটে দূরে যেতে হয়।’
দিনকে দিন রাঙামাটিতে বাড়ছে জনবসতি। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির সংকট। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি জনপদগুলোর মানুষই পড়ছেন সবচেয়ে বেশি পানির ভোগান্তিতে। সংকট এতটাই প্রকট যে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সুরাহা করতে সক্ষম হচ্ছে না। সব মিলিয়ে জেলার ৫০ শতাংশ মানুষই পানির সংকটে ভুগছেন। আর পৌর এলাকায় এই সংকটে ভুগছেন ৭০ শতাংশ মানুষ। এর পরও যতটুকু পানি মেলে, তা সরবরাহের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে রাঙামাটি জেলা পরিষদ, এডিবি খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) আর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দাবি, রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলার ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পানির সুবিধায় আনা গেছে। আগামী পাঁচ বছরে তা ৭৫ শতাংশে উন্নীত হবে। আর পৌর এলাকার মাত্র ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এসেছে পানি সুবিধার আওতায়, যা শতভাগ হতে ২০৪৫ সালকে টার্গেটে নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে কাউখালী, বাঘাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও রাজস্থলীতে পানির সংকট বেশি। প্রাকৃতিক উৎসের ওপরই তাদের সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়। আবার কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে যুক্ত উপজেলাগুলোর মানুষ হ্রদের পানি পান ও ব্যবহার করে থাকে। এতে করে পানিবাহিত নানান রোগেও ভুগতে হয় সেখানকার জনগোষ্ঠীকে। এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে প্রায়শই। কাউখালী উপজেলার দুর্গম ফটিকছড়ি ইউনিয়নের আয়তন ৭৭ বর্গমাইল। ২৭টি গ্রামে সাড়ে সাত হাজার মানুষের বসবাস সেখানে। অথচ প্রয়োজনীয় সংখ্যক নলকূপ নেই। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা বলেন, ‘মানুষকে ছড়া বা নদীর কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে পান ও ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে নানান পানিবাহিত রোগে ভুগতে হয় গ্রামবাসীকে। আমরা বিভিন্ন মহলে তদবির করছি সংকট সমাধানে।’
বরকল আইমাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুবিমল চাকমা বলেন, ‘বরকল পাহাড় আর পাথুরের এলাকা হওয়ায় এখানে পানির সংকট প্রকট। নলকূপ স্থাপন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। নদীর পানিও পানের উপযোগী নয়। ফলে মানুষকে ছড়া বা কুয়ার পানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। আবার পানি ফুটিয়ে পান করতে অভ্যস্ত নন পাহাড়ের মানুষ। তাই পানিবাহিত রোগেও ভুগতে হয়।’
রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, ‘পাহাড়ে অনেক প্রতিকূলতা আছে। দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো যায় না। তাই কাজ করা সম্ভব হয় না। এখানে শুধু এক ধরনে টেকনোলজি দিয়ে হচ্ছে না। ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী যেখানে যে টেকনোলজি দিয়ে কাভারেজে দেওয়া সম্ভব, আমরা সেটাই প্রয়োগ করছি।’ তার দাবি, ‘নতুন প্রকল্প পাস হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জেলার ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পানি সুবিধার আওতায় আনা যাবে।’
৬৪ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাঙামাটি পৌরসভার লোকসংখ্যা ৮৪ হাজার ৮০৪ জন। এর মধ্যে কেবল ৩০ শতাংশ পৌরবাসীকেই পানি সুবিধার আওতায় আনা গেছে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে। তিনি বলেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। এর আলোকে ২০৪৫ সালের মধ্যে রাঙামাটি পৌরসভাকে শতভাগ পানি সুবিধার আওতায় আনা হবে।’