সারা দেশে ফ্যামিলি কার্ডে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য বিপণন শুরু করেছে সরকার। গতকাল রবিবার শুরুর দিন পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ সারি ছিল। প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল নারীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ময়মনসিংহ ও রংপুর সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডে একেকজনের হাতে একাধিক কার্ড দেখা গেছে।
পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে সরকার এক কোটি গরিব পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় টিসিবির পণ্য দিচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কার্ড বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গতকাল রবিবার দুপুর ১২টায় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী। এ সময় তিনি হুঁঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, রমজান মাসে মানুষ যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য পায় সে জন্য ভর্তুকি দিয়ে পণ্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার। মানুষের এই খাদ্যপণ্য নিয়ে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী যদি মজুদসহ কোনোরূপ কারসাজি করেন, তবে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হবে। এ জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে।
সিলেট নগরের হাউজিং এস্টেট, মদিনা মার্কেট কালীবাড়ি পয়েন্ট, চৌহাট্টায় আলিয়া মাদরাসা মাঠসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কার্ড হাতে মানুষের দীর্ঘ সারি। কোথাও সুশৃঙ্খলভাবে, কোথাও হুড়াহুড়ির মধ্যে চলছে পণ্য কেনার চেষ্টা। তীব্র দাবদাহের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি মাটিতে বসে পড়েন। অনেকে কার্ড ছাড়াই পণ্য কিনতে আসে। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে যায় তারা।
নগরের আলিয়া মাদরাসা মাঠে টিসিবির পণ্য কিনতে আসেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ১ ওয়ার্ডের দরগা মহল্লা এলাকার বাসিন্দা রাজিব আহমদ। তিনি বলেন, ‘কার্ড সিস্টেম চালুর পর প্রথম আসলাম নিত্যপণ্য কিনতে। ভিড় বেশি হলেও কার্ড থাকায় একটা নিশ্চয়তা আছে আগে হোক বা পরে হোক পণ্য কেনার সুযোগ পাব। ’
সিলেট সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের টিসিবির ডিলার সহিদ আহমদ দুপুর আড়াইটার দিকে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে প্রায় ২২০০ জনকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিন ৫০০ পরিবারের কাছে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। বাকিরা পর্যায়ক্রমে কিনতে পারবে। ’ কার্ডের সংখ্যা আরো বাড়ানো দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আরো অনেক পরিবার কার্ডের বাইরে রয়ে গেছে। তারা এসে ভিড় করছে। তাদের ফিরতে হচ্ছে হতাশ হয়ে। ’
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘ সারি। সুশৃঙ্খলভাবে চলছে পণ্য বিক্রি। তবে অনেকের হাতেই একাধিক কার্ড। কারো কারো হাতে চার-পাঁচটি করে কার্ড। সেখানে অনেকে অভিযোগ করেন, ধনী পরিবার নিজেরা বিক্রয়কেন্দ্রে না এসে পরিচিত দরিদ্র লোকদের পাঠিয়েছে। এ ছাড়া উপযুক্ত অনেকে আগ্রহ দেখালেও কার্ড পায়নি। তারা পণ্য না নিয়ে ফিরে গেছে। আবার কোনো পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোনও কার্ড পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ময়মনসিংহ সিটির ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোট আটটি স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়। তবে লাইনে দাঁড়ানো অনেকের হাতেই ছিল একাধিক কার্ড। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাচিঝুলি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয়স্থলে রাম রাজ নামের এক ব্যক্তির হাতে পাঁচটি কার্ড ছিল। তিনি জানান, অন্যরা তাঁর আত্মীয়-স্বজন। জলিল নামের একজনের হাতে দেখা গেল তিনটি কার্ড। সেলিম মিয়া নামের একজন এসে অভিযোগ করেন, গরিব হলেও এলাকার ভোটার না হওয়ায় কার্ড পাননি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্ড বিতরণের একটি তালিকা করেছেন। আবার সিটি করপোরেশন থেকেও তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থায় কেউ কেউ একাধিক কার্ড পেয়েছে। আবার অনেকে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নিয়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল এমন অনেকে কার্ড পেয়েছে।
৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম শরীফ জানান, তাঁর এলাকায় দুই হাজার ২০০ জনকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি ওয়ার্ডে এক হাজার ৮০০-এর মতো কার্ড দিয়েছেন। ৪০০ কার্ড দেওয়া হয়েছে সরাসরি সিটি করপোরেশন থেকে। তিনি বলেন, তিনি চেষ্টা করেছেন যেন প্রকৃত লোকজন কার্ড পায়। তবে দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটতে পারে।
রংপুর নগরের শালবন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সকাল ১১টায় দীর্ঘ সারি ছিল। মধ্যবিত্ত অনেককে পণ্য কিনতে দেখা যায়। অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা রাজি হয়নি। তবে সাবেক রেলওয়ে কর্মকর্তা বজলুর রহমান বলেন, মধ্যবিত্ত পর্যায়ের হলেও টিসিবির পণ্য নিতে এসেছেন তিনি। টিসিবির পণ্যসামগ্রী নিতে আসা মধ্যবিত্ত এক নারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘রোদের মধ্যে এভাবে লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা পাচ্ছি। ’
রংপুর সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জামাল উদ্দিন বলেন, ওয়ার্ডটি নগরীর ভিআইপি এলাকা। এখানে গরিব মানুষের সংখ্যা কম। কার্ড বিতরণে অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রে অনেক মহিলার স্বামীর স্থলে বাবার নাম থাকায় অনেককে শনাক্ত করতে পারিনি। ফলে একই পরিবার দু-তিনটি করে কার্ড পেয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি দুই হাজার ৫২৪টি কার্ড পেয়েছি। এর মধ্যে এখনো ৩০০ কার্ড আমার কাছে আছে। কেউ নিয়ে যায়নি। ’
এসব কার্ডের পণ্য কী করা হবে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ডিসি অফিস ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, স্পটেই নাম-ঠিকানা লিখে টাকার বিনিময়ে গরিব মানুষের কাছে পণ্য বিক্রি করতে। কোনো পণ্য ফেরত নিয়ে যাওয়া যাবে না। ’
এ বিষয়ে রংপুর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন মিয়া বলেন, ‘কার্ড বিতরণে অনিয়মের কোনো অভিযোগ পাইনি। কেউ অভিযোগ করলে তা তদন্ত করে দেখা হবে। ’
বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ২০ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে প্রথম কিস্তিতে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হবে। দ্বিতীয় কিস্তিতে ৩ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি। সুশৃঙ্খলভাবে পণ্য বিক্রির জন্য দেশব্যাপী তালিকা তৈরি করে বিশেষ ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সুবিধাভোগী পরিবারের তালিকায় রয়েছে করোনায় মহামারিতে নগদ সহায়তা পাওয়া ৩০ লাখ পরিবার। এ ছাড়া পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনসংখ্যার দরিদ্রতা সূচক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা-উপজেলা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে দেওয়া হয় ৫৭ লাখ ১০ হাজার কার্ড। সব মিলিয়ে ৮৭ লাখ পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য দেওয়া হচ্ছে।