অননুমোদিত ও অবৈধ ভবন ভাঙা অভিযান থেমে গেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওততাধীন এলাকায়। শুধু রাজউক নয়, সিটি করপোরেশনেরও এ ধরনের কোনো তৎপরতা এখন আর চোখে পড়ছে না। এমনকি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদতীরের অবৈধ দখল করা জমি উদ্ধারের তৎপরতাও নেই। মাঝখানে কিছু দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন। এখন এরই সুযোগে প্রতিদিনই রাজধানীতে উঠে যাচ্ছে নতুন নতুন অননুমোদিত স্থাপনা ।
ঢাকা মহানগরী ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর অন্যতম। এক শ’ বছর আগের বাংলাদেশ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে গেছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরেকটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার সময় হয়ে গেছে। এক শ’ বছর আগে ঢাকা ছিল ছোট একটি শহর। সিলেটে অথবা সিলেটের আশপাশের বড় ভূমিকম্পের আঁচড় ঢাকাতেও লেগেছিল। তখন তেমন বড় স্থাপনা না থাকায় ঢাকায় বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কোনো কোনো ভবনে ফাটলও দেখা দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। কিন্তু এখন ঢাকার আশপাশে ৭ অথবা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হবে ধারণাতীত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে পুরান ঢাকায়। কারণ পুরান ঢাকার অনেক ভবন ১০০ বছরের বেশি পুরনো। এ ছাড়া নকশা অনুমোদন ছাড়া কেবল রাজমিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করা অনেক ভবনও ঢাকায় রয়েছে সেখানে। এসব ভবন বড় ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে না, ভেঙে পড়বে। ফলে জানমালের প্রচুর ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে। সে কারণে পুরনো, জরাজীর্ণ ও রাজউকের অনুমোদনহীন দুর্বল ভবনগুলো ভূমিকম্প হওয়ার আগেই ভেঙে ফেলা উচিত।
এ ব্যাপারে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আজহার উদ্দিন সরকারও রাজউকের উদ্দেশে একটি প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার অননুমোদিত ও জরাজীর্ণ ভবনগুলো ভেঙে রাজউক সবাইকে নতুন নকশা করে দিতে পারে। অন্য দিকে ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে; যেন এসব বাড়িঘরের মালিকরা পুরনো, জরাজীর্ণ ও অনুমোদনহীন বাড়িগুলো ভেঙে যেন নতুন করে মজবুত বাড়ি নির্মাণ করতে পারে।
প্রকৌশলী আজহার আলী বলেন, ‘নতুন নকশা দিয়ে বাড়ি করলে দুর্ঘটনা যেমন এড়ানো সম্ভব আবার ভবনের নান্দনিকতাও বৃদ্ধি পাবে। পুরান ঢাকায় ছোট একটি প্লটের মালিক বেশ কয়েকজন। তারা কয়েকটি প্লট একত্রিত করে যেন নতুন বাড়ির নকশা নেন সে জন্য রাজউক বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারে। ব্যাংক ঋণ দিলে ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস অর্থ কাজে লাগবে তেমনি অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারও হবে।’
উল্লেখ্য, পুরান ঢাকাকে নতুন করে গড়ে তুলতে রাজউক কিছু উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন বাড়ির মালিকদের সহায়তা করলেও পুরনো, জরাজীর্ণ ভবন ছেড়ে তারা নতুন ভবন তৈরিতে উৎসাহী হতে পারেন। এটা করলে পুরান ঢাকা আবারো বাসযোগ্য হয়ে উঠবে এবং ভূমিকম্পের দুর্ঘটনাসহ অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে সেখানকার মানুষ।
রাজউকের কর্মকর্তারাই বলছেন, ঢাকা মহানগরীর যত্রতত্র অননুমোদিত ভবন যথাযথভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ম মেনে না করায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারবে না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে অনেক বেশি। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, অপরিকল্পিত ভবনগুলো ভূমিকম্পে ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে; কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল প্রয়োগ করে ভবন করা হলে সেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব। আবার পুরনো কিন্তু ঐতিহ্যবাহী অনেক ভবন ঢাকায় রয়েছে। সেগুলো না ভেঙে ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল প্রয়োগ করেও শক্ত ও মজবুত করে গড়ে তোলা যাবে। সে জন্য রাজউক ও সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
এ ছাড়া ঢাকার অনেক ভবনে নিচের অংশে কোনো ঝামেলা না থাকলেও হঠাৎ করে উপরের দিক থেকে ভবনের চার পাশ বাড়িয়ে ফ্লোর স্পেস বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র পল্টনের কালভার্ট রোডে এ ধরনের ভবন দেখতে পাওয়া যাবে। আবার গুলশান-বনানীতে এমন অনেক ভবন গড়ে উঠেছে যা পুরোপুরি অবৈধ। রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই তা গড়ে উঠেছে। গুলশান-১-এর গোলচত্বরের লাগোয়া সুপার মার্কেটটি এমন ধরনের আরেকটি ভবনের উদাহরণ। এটা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক এমন ভবন রয়েছে যেখানে ছয় তলার অনুমোদন নিয়ে ১০ তলা করা হয়েছে। এমন অনেক ভবন রয়েছে যেগুলোর নকশা অনুমোদনে সামনে-পেছনে কোনো বারান্দা ছিলনা; কিন্তু পরে নির্মাণের সময় দ্বিতীয় তলা থেকেই বারান্দা গড়ে তোলা হয়েছে। ভবনের উপরের দিকে এমনভাবে বারান্দা তৈরি করা হয়েছে যার পুরোটাই রাস্তার উপর। উপরের তলায় বলে চলাচলরত যানবাহনের কোনো সমস্যা হয় না; কিন্তু নিচের তলা নকশা অনুযায়ীই করা হয়েছে।
রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কাছেই রয়েছে ১০ হাজারের মতো অবৈধ ভবনের তালিকা। প্রায় এক যুগ আগে এ তালিকা করা হলেও তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।