রাশিয়া শনিবার দাবি করেছে, সন্দেহজনক ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র কারণে ইউক্রেন তার নিজেদের এক আলোচককে গুলি করে হত্যা করেছে। মস্কো দাবি করেছে, ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনী (এসবিইউ) আলোচক ডেনিস কিরিভকে গ্রেফতার করার সময় হত্যা করে। দেশটির গোয়েন্দরা ধারণা করছেন, রাশিয়ার সাথে আলোচনার সময় এই লোক গোপন তথ্য পাচার করছিল।
কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানায়, এসবিইউ বিশ্বাসঘাতকার সন্দেহে ইউক্রেনের এক আলোচককে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে ইউক্রেনের সরকার কোনো তথ্য জানায়নি।
উল্লেখ্য, বেলারাশে অনুষ্ঠিত রাশিয়া-ইউক্রেন প্রথম দফার আলোচনায় ডেনিস উপস্থত ছিলেন।
যুদ্ধবিরতির দেখা নেই
অবশেষে ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটা শোনা গিয়েছিল রাশিয়ার মুখে। শনিবার সকালে তারা ঘোষণা করেছিল, মস্কোর সময় অনুযায়ী সকাল ১০টা থেকে ইউক্রেনের মারিয়ুপোল ও ভোলনোভকায় বন্ধ রাখা হবে হামলা। সাধারণ মানুষকে উদ্ধারের পথ করে দেয়া হবে। তা-ই হলো। নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হলো গোলাগুলি। অর্ধমৃত মানুষগুলো যুদ্ধের ক্লান্তি নিয়ে বেরিয়ে এলো বাঙ্কার থেকে। ঠিক তখনই ফের কানফাটানো আওয়াজ, …সব কথার কথাই রইল। বরং আরো শক্তি বাড়িয়ে দিনভর চলল রুশ গোলাবর্ষণ। তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিতে হলো উদ্ধার অভিযান।
দ্বিতীয় পর্যায়ের শান্তি বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন, দু’দেশই কথা দিয়েছিল, যুদ্ধের মাঝে আটকে থাকা নিরীহ মানুষজনকে উদ্ধারের পথ করে দেয়া হবে। এর পরের ২৪ ঘণ্টা এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি রাশিয়া। কিন্তু যা তারা বলল, আর যা করল, তাতে স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব।
কথার খেলাপ করা বা ভুয়া তথ্য দেয়া, যুদ্ধের গোড়া থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ উঠছে। শুক্রবার তারা একটি রিপোর্টে দাবি করে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এ-ও জানায়, পোল্যান্ডে রয়েছেন তিনি। শনিবার সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে ইনস্টাগ্রামে হাজির হন জেলেনস্কি। কিয়েভে নিজের অফিসে বসে ভিডিও করে তা পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সঙ্গে লেখেন, ‘আমি কিয়েভেই আছি। এখানে বসে কাজ করছি। কেউ কোথাও পালিয়ে যায়নি।’ এর পরে আর তাদের মতামত জানায়নি মস্কো। বরং শনিবার তারা নতুন খবর দিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী ডেনিস কিরিভকে খুন করা হয়েছে। খবর ছড়িয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে খুন করেছে ইউক্রেন।
আজভ সাগরের তীরে ইউক্রেনের মারিয়ুপোল বন্দরটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেরসেন বন্দরকে দখল করতে পারলেও এটিকে এখনও কব্জা করতে পারেনি রাশিয়া। গত কয়েক দিন ধরে বিধ্বংসী হামলা চলছে এ শহরে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে মারিয়ুপোলের মেয়র শুক্রবার জানান, পরিস্থিতি এমনই, কেউ জখম হলে তাকে যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথটুকু রাখছে না রুশরা। প্রায় একই অবস্থা ভোলনোভকায়। আজ সকালে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, এই দুই শহর থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধারের জন্য নিরাপদ করিডর করে দেয়া হবে। যুদ্ধ বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু কতক্ষণের জন্য, তা উহ্য রাখে মস্কো।
কতক্ষণ রুশ হামলা বন্ধ ছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে যুদ্ধবিরতির খবর প্রকাশ্যে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইউক্রেন জানায়, উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে। মারিয়ুপোল থেকে জাপোরিজিয়া যাওয়ার রাস্তাটিকে মানব করিডর করা হয়েছিল। ওই রাস্তাটিকে নিশানা করেই গোলাবর্ষণ শুরু করে রাশিয়া। যে যেখানে পারে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়। যারা রওনা দিয়েছিলেন, মাঝপথ থেকে তাদের অনেকে ফিরে আসেন। তারা জানান, রাস্তায় ততক্ষণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে একাধিক লাশ। পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দফতরের উপপ্রধান কিরিলো টিমোশেঙ্কো সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি মানা হয়নি। ক্রমাগত হামলা চালানো হয়েছে মারিউপোল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়।’’
ভোলনোভকাতেও কথা রাখেনি ক্রেমলিন। উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুকও সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘হামলা বন্ধ রাখার জন্য আমরা রাশিয়ার কাছে বারবার আবেদন জানাচ্ছি।’ একটি রুশ দৈনিকের রিপোর্টে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চলাকালীন রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে নিশানা করে হামলা চালানো হয়েছিল। জেলেনস্কি এ দিনও বলেন, ‘যা যা করা সম্ভব, করে চলেছি। দেখা যাক, কথা বলে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারি কি না।’
মারিউপোলের পরিস্থিতি ভীষণই শোচনীয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে রুশরা। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় ঘর গরম রাখার উপায় নেই। ফোনের পরিষেবা নেই। খাবার নেই, পানি নেই। ওষুধের দোকানগুলোতে ওষুধও নেই। মারিউপোলের মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো জানান, যুদ্ধবিরতির কথা শুনে শহর ছেড়ে পালাতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বাস ছাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎই গোলাবর্ষণ শুরু হয়। বয়চেঙ্কো বলেন, ‘শহরের সব বাসিন্দার জীবনের দাম আছে। আমরা ঝুঁকি নিতে পারি না। উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’
ব্রাসেলসে ন্যাটোর বৈঠকে যোগ দেয়ার পরে শনিবার পোল্যান্ডে পৌঁছেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এখানে ইউক্রেনের মন্ত্রীদের সাথে বৈঠকে বসতে পারেন তিনি। ইউক্রেনের আকাশপথকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করতে ন্যাটোর কাছে আবেদন জানিয়েছিল কিয়েভ। আকাশপথে রুশ হামলা ঠেকাতেই এই সাহায্য চেয়েছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু গত কাল তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে ন্যাটো। তাদের ব্যাখ্যা, ইউক্রেনকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হলে, পরমাণু শক্তিধর দেশ রাশিয়াকে আরো উস্কে দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ আরো বড় আকার নিতে পারে ইউরোপে। পরে শনিবার রাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোর বক্তব্যের রেশ ধরে বলেন, ‘ইউক্রেনের আকাশকে ‘নো-ফ্লাই জোন করায় যারা সমর্থন জানাবে, ধরে নেয়া হবে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে নামতে চাইছে। শুধু ইউরোপ নয়, সে ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
ক্ষুব্ধ জোলেনস্কি তার বক্তৃতায় ন্যাটো গোষ্ঠীর দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছেন, ‘এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী আপনারা। আপনাদের দুর্বলতা, অনৈক্যের জন্যই এটা ঘটছে।’ জেলেনস্কির অভিযোগ, বিমান-হানা অনিবার্য জেনেও ইউক্রেনের আকাশকে ‘নো ফ্লাই জ়োন’ ঘোষণা করেনি নেটো। তিনি বলেন, ‘আজ ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে স্পষ্ট হয়ে গেল, ইউরোপের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টিতেই সবাই একমত নয়।’
রাষ্ট্রনেতারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকলেও আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে লাগাতার যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এমনকি রাশিয়ার বড় শহরগুলোতেও পথে নামছেন হাজার হাজার বাসিন্দা। ভিডিও-বার্তায় তাদের কাছেও সাহায্য চেয়েছেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শেষ হয়ে যাই, আপনারাও হবেন।’ শোনা যাচ্ছে, ‘ঘরের অশান্তি’ সামলাতে মাঝেমধ্যেই ফেসবুক, টুইটার ব্লক করে দিচ্ছে মস্কো। সরকার-বিরোধী খবর রুখতে মিডিয়াকেও চাপে রাখছে তারা।
যুদ্ধ আজ ১১ দিনে পা রেখেছে। নিহতের সংখ্যার কোনো হিসাব নেই। জখম হাজার হাজার মানুষ। যারা দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি বা পালিয়ে যাননি, যুদ্ধে না-মরলেও তারা হয়তো না-খেতে পেয়ে কিংবা ঠান্ডায় মরবেন। ক্রমশ সেই আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ আজ জানিয়েছে, অন্তত দেড় কোটি মানুষ সব হারাতে বসেছেন। ইতিমধ্যেই ১৪ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছেন। কিয়েভের সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশনে আজও আতঙ্কে ভরা মুখের ছড়াছড়ি। তারা যেকোনো উপায়ে হোক পালাতে চান। রাজধানীর বাইরে ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রুশ সেনা কনভয় দাঁড়িয়ে। এখনো তাদের ঠেকিয়ে রেখেছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। আশঙ্কা, যেকোনো সময় বাঁধ ভাঙবে। এক বাসিন্দার কথায়, ‘আমরা ন্যাটোয় যোগ দিতে চেয়েছিলাম, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চেয়েছিলাম। এটাই অপরাধ! তার জন্য এই দাম দিতে হলো!’ কিয়েভের বাসিন্দা সেনিয়ার কথায়, ‘এখন আর কিছু চাই না। শুধু বাঁচতে চাই।’
সূত্র : রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড ও আনন্দবাজার পত্রিকা