নতুন ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করে বসে আছেন ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩৩ জন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কেন্দ্রীয় সার্ভারে এসব মানুষের আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় তারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বেশি আবেদন ঝুলে আছে ঢাকা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোয়। এছাড়া তালিকায় আছেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৩৮ জন দ্বৈত ভোটার। রোববার নির্বাচন কমিশনের মাসিক সমন্বয় সভায় এসব পরিসংখ্যান উঠে আসে। সভায় নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সভাপতিত্ব করেন। অপর একটি সূত্র জানায়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত নতুন ভোটার নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছেন ১৯ লাখ ১০ হাজার ৪৭৩ জন। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে ভোটার হয়েছেন। নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ায় তাদের সামনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরুর প্রস্তাব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি সচিবালয়। প্রসঙ্গত, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চারজন কমিশনার শপথ নিয়েছেন। আজ সোমবার তারা আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস শুরু করবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াই ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে কেএম নূরুল হুদা কমিশন। ফলে এ কাজে জড়িতরা পরিপূর্ণ তথ্য পাননি। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেও তারা ভোটার তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন। একই কারণে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি। জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে বাধ্য হয়ে তারা নিজ উদ্যোগে অনলাইনে অথবা সরাসরি নির্বাচন অফিসগুলোয় গিয়ে ভোটার হওয়ার আবেদন করছেন। ফলে বিপুলসংখ্যক অনলাইন আবেদন ঝুলে আছে। অফলাইন বা সরাসরি কতসংখ্যক আবেদন ঝুলে আছে, এর কোনো পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় সার্ভারে নেই। এসব আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় চরম ভোগান্তির মধ্যে আছেন সাধারণ মানুষ।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, গত বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ও মৃত ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করা না হলেও আগামী ২ মার্চ ভোটার দিবস উদ্যাপন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, রক্ষা করব ভোটাধিকার’। দিবসটি উদ্যাপনে নানা কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। ওইদিন ১৪ লাখ ২ হাজার ৫০৬ জন নতুন ভোটার এ তালিকায় যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। নতুনরা যুক্ত হলে দেশে মোট ভোটার দাঁড়াবে ১১ কোটি ৩১ লাখ ২৩ হাজার ১৪৫ জনে। এবার যে ১৪ লাখ ২ হাজার ৫০৬ জন নতুন ভোটার হচ্ছেন, তাদের তথ্য ২০১৯ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করেছিল ইসি। তখন তাদের বয়স ছিল ১৬ বছর। দুই বছরে তাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাদেরকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের পর আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেনি কমিশন।
সূত্র আরও জানায়, গত বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ও মৃত ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কারিগরি সংক্রান্ত কমিটি বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার পরিবর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য নেওয়ার সুপারিশ করে। অপরদিকে বিদায়ি নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে কমিশনারদের মতপার্থক্য থাকায় ওই সময়ে এ কর্মসূচি আলোর মুখ দেখেনি। নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ায় তাদের সামনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরুর প্রস্তাব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপস্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ রোববার যুগান্তরকে বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম আমাদের অগ্রাধিকার কাজের তালিকায় রয়েছে। গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এ কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। এবার এ কার্যক্রম নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়টি কমিশনের কাছে অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, অনেক মানুষ এখনো ভোটার তালিকার বাইরে রয়েছেন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের দরকার হচ্ছে, তারাই ভোটার হচ্ছেন। বাকিরা আসছেন না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করলে বাকিরাও ভোটার তালিকার আওতায় চলে আসবেন।
নির্বাচন কমিশনের জেলা পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অনলাইন ও অফলাইন দুই পদ্ধতিতে নতুন ভোটার হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা আবেদন করছেন। দুই বছর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ না করায় নির্বাচন অফিসগুলোয় নতুন ভোটার হতে আগ্রহীদের চাপ বাড়ছে। প্রতিদিন প্রতিটি থানা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসগুলোয় একশ থেকে তিনশ মানুষ ভিড় করছেন। জনবল ও সরঞ্জামাদি সংকটের কারণে এতসংখ্যক মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে একদিকে সাধারণ মানুষের হয়রানি হচ্ছে, অপরদিকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তারা বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধক টিকা গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, বিদেশ যাওয়াসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে এসব সেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন।
ইসি সূত্রে জানা যায়, সমন্বয় সভায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর নতুন ভোটারদের ঝুলে থাকা অনলাইন আবেদনের বিষয়টি তোলেন। সভায় তিনি জানান, বর্তমানে সেন্ট্রাল সার্ভারে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩৩টি আবেদন পেন্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে ৩৯ হাজার ৯০৯টি, চট্টগ্রামে ১ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৬টি, কুমিল্লায় ২ লাখ ২ হাজার ৬৮০টি ও ঢাকা অঞ্চলে ২ লাখ ৯ হাজার ৮৮টি আবেদন রয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৬৪টি, রাজশাহীতে ৮০ হাজার ২১৪টি, রংপুরে ৭৫ হাজার ৯৮৪টি, সিলেটে ৭৫ হাজার ৮৮৯টি, ফরিদপুরে ৫৩ হাজার ৮৭১টি এবং খুলনা অঞ্চলে ৮৮ হাজার ৭৪টি আবেদন পেন্ডিং রয়েছে। যদিও এই পরিসংখ্যান নিয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, অনেক ভোটার আবেদন করার পর ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ দিতে নির্বাচন অফিসে আসেন না। আবার অনেকে ভিন্ন তথ্য দিয়ে একাধিকবার আবেদন করেছেন। এ কারণে সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঝুলে থাকা আবেদনের সংখ্যা কম হবে। তবে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করার কারণে মানুষের কষ্টের বিষয়টিও সভায় জানান। তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ কার্যক্রম শুরুর প্রস্তাব দেন।