গাড়ি, বাড়ি ও পুলিশ প্রটেকশনসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে দিয়েছেন বিদায়ি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা ও চার কমিশনার। দায়িত্ব থেকে বিদায়ের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতেই তাদের ব্যবহৃত সরকারি গাড়ি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নিয়ে আসা হয়। ওই রাতেই প্রত্যাহার করা হয় সবার পুলিশ প্রটেকশন।
তাদের পরিবারের ব্যবহার করা পাঁচটি গাড়ি পরের দিন নিয়ে আসা হয় কমিশন সচিবালয়ে। চালক না থাকায় বিদায়ি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ইতোমধ্যে চড়েছেন উবারের গাড়িতে। মিন্টো রোডের সরকারি বাসা ছেড়ে দিয়েছেন সিইসি। বাকি চার কমিশনারদের তিনজনই নিজেদের বাসাতেই অবস্থান করছেন। তবে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম আগের মতো উঠেছেন ভাড়া বাসায়।
বিদায়ি কমিশনের সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের অবসর সময় কাটছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। বই পড়ে, সংবাদ দেখে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটছে তাদের। প্রয়োজন ছাড়া তারা খুব একটা বাইরে বের হচ্ছেন না। দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কেউ বিদেশে যাননি। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও যোগ দেননি কেউ। নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে তাদের কেউই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশের কাছে আবেদনও করেননি। মো. রফিকুল ইসলাম ছাড়া বাকি চারজনই অবসর সময়ে বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইসি সচিবালয় ও পাঁচ কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের পাঁচ বছর মেয়াদ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। ওইদিন রাতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের দেওয়া বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে কমিশন ত্যাগ করেন তারা। যদিও তাদের পাঁচ বছর মেয়াদের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। নতুন নির্বাচন কমিশনের নাম এখনো ঘোষিত হয়নি। আজ মঙ্গলবার কমিশনার পদে ১০ জনের নাম সার্চ কমিটির চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। ওই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন। এজন্য নতুন কমিশনার বরণে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নিয়ে ওই রাতেই উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত নিজ বাসায় ওঠেন বিদায়ি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। বর্তমানে ওই বাসাতেই অবস্থান করছেন তিনি ও তার স্ত্রী। তবে তার সন্তানরা থাকেন বিদেশে। নির্বাচন কমিশনার থাকাবস্থায় মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে থাকতেন সিইসি। তখন তার নিরাপত্তায় ছিল পুলিশের প্রটেকশন। দায়িত্ব ছাড়ার পরপরই ওই রাতেই তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও চলে যান। পরে তিনি আর পুলিশের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনও করেননি।
সিইসি পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর কেএম নূরুল হুদার অবসর সময় কাটছে ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে। বাসার বাজার নিজেই করছেন। এর মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে শপিংমলসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতেও যান। তবে দূরযাত্রায় কোথাও যাননি। বিদায়ের আগে তিনি জানিয়েছিলেন, তার সন্তানরা আমেরিকা থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব থাকায় সেখানে তিনি যাবেন না। সামনের দিনগুলোতে বই লেখার প্রতি মনোযোগী হবেন সাবেক এই সিইসি। তবে তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো বই লিখবেন না।
সিইসির পদ থেকে দায়িত্ব ছাড়ার পর কীভাবে সময় কাটছে জানতে চাইলে কেএম নূরুল হুদা সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগ থেকেই মিন্টো রোডের বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যেদিন কমিশন থেকে বিদায় নিয়েছি সেদিনই নিজ বাসায় চলে এসেছি। এখনো বাসার সবকিছু গোছাতে পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রায় প্রতিদিনই স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে বের হই। শপিং করি, বই পড়ি, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই-এভাবেই সময় কাটছে।’
অবশ্য উবারের গাড়িতে চড়ছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। নিজের গাড়ি থাকলেও নেই চালক। নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরপরই সরকারি দুটি গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। নেই তার পুলিশ প্রটেকশনও। এ কারণে বাইরে যেতে উবারের গাড়িতে চড়েছেন তিনি। যদিও খুব জরুরি কাজ বা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সহসাই তিনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। থাকছেন বারিধারা কূটনৈতিক জোনের নিজ বাড়িতেই। পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করার ইচ্ছে রয়েছে তার। তবে পরিবারের আপত্তি থাকায় আপাতত যেতে পারছেন না তিনি।’
নির্বাচন কমিশনার পদে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর তিনি বেশিরভাগ সময় বিশ্রাম ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটিয়েছেন। অবসর সময় কাটাতে চান বই লেখা নিয়ে। নির্বাচন কমিশনার পদে থাকাবস্থায় এক হাজার ২০০ পৃষ্ঠার ‘নির্বাচন নামা’ শীর্ষক একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি লেখেন তিনি। ওই বইতে বিদায়ি কমিশনের পাঁচ বছরের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। ওই পাণ্ডুলিপিতে সংযোজন-বিয়োজন করায় হাত দিয়েছেন তিনি। তবে বইটি প্রকাশ করা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি। এছাড়া নিজের আত্মজীবনী নিয়েও একটি বই লিখতে চান। সেটির কাজেও হাত দিয়েছেন বিদায়ি এই কমিশনার। এছাড়া বিদায় নেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের লাইব্রেরিতে ব্যক্তিগত সংগ্রহে তারা কয়েকশ বই জমা দিয়েছেন।
সারাদিন বাসাতেই টিভি দেখে, পত্রিকা ও বই পড়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেনন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম। ধানমন্ডির ভাড়া বাসাতেই অবস্থান করছেন তিনি। সন্তানরা বিদেশে অবস্থান করায় তিনি ও তার স্ত্রী রয়েছেন ওই বাসায়। এখানেই থাকার পরিকল্পনা রয়েছে তার। নির্বাচন কমিশনার থাকাবস্থায় ওই বাসাতেই ছিলেন। নির্বাচন কমিশনার পদ থেকে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরই তার সরকারি দুটি গাড়ি ও পুলিশ প্রটেকশন ছেড়ে দেন তিনি। গানম্যান চেয়ে পরে কোনো আবেদন করেননি। এ বিষয়ে মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘গানম্যান কেন লাগবে। আগে দায়িত্বে ছিলাম তখন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ প্রটেকশন থাকত। এখন এসবের কোনো দরকার নেই।’
আইন পেশায় মনোযোগী হতে কাজ করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান খুলতে বিভিন্ন জায়গায় অফিসও দেখছেন তিনি। সাবেক জেলা জজ ছিলেন এমন কয়েকজনকে নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান গড়ার ইচ্ছা রয়েছে তার। তিনি হাইকোর্টের তালিকাভুক্ত একজন আইনজীবী। এ পেশাতেই অবসর সময় কাটানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার। এছাড়া নির্বাচন কমিশনে তার পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালন এবং জেলা জজ থাকাবস্থায় তার দেওয়া বিভিন্ন রায় নিয়ে পৃথক বই লেখার কাজও গুছিয়ে নিচ্ছেন। বাকি সময় বিশ্রাম, গল্প ও ঘোরাঘুরি করে সময় কাটছে তার।
নির্বাচন কমিশন থেকে চলে আসার পরপর তিনিও সরকারি গাড়ি ও পুলিশ প্রটেকশন ছেড়েছেন। এখন নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চলাচল করেন। থাকছেন পান্থপথের নিজ বাড়িতে। অবসর সময় কাটছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এছাড়া তিনি বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন। অবসর সময়ের বিষয়ে কবিতা খানম যুগান্তরকে বলেন, ‘সারাজীবন আইন পেশায় ছিলাম। তাই বাকি জীবনে এ পেশায় থাকতে পারি-সেই চেষ্টা করছি। এছাড়া বইও লিখব ভাবছি।’
নিজ বাসায় স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। থাকছেন মিরপুর ডিওএইচএস’র নিজ বাসাতেই। ব্যস্ত আছেন স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে। কমিশনার থাকাবস্থায় তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। হার্টে রিং পরানো হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি তার করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। এরপর থেকে তিনি বাসায় অবস্থান করছিলেন। এ কারণে বিদায়ের দিন তিনি নির্বাচন কমিশনেও যেতে পারেননি।
তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার সরকারি গাড়ি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রটেকশনও নেই। বর্তমানে তিনি করোনাভাইরাসমুক্ত হলেও বাসাতেই অবস্থান করছেন। স্ত্রী ও মেয়ের ব্যবসায় মনোযোগী হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার থাকাবস্থায় বই লেখা শুরু করেন তিনি। ওই বই লেখা শেষ করতে চান তিনি।