বহুল আলোচিত-সমালোচিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা ও চার কমিশনারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। তাদের মেয়াদে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সারা দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের ছয় হাজার ৬৯০টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুমিল্লা, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ইসি প্রশংসিত হয়। কিন্তু বাকি প্রায় সব নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যে পড়ে এ কমিশন। শুধু তাই নয়, কমিশনারদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগ করেন ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। এমনকি এ পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বিরুদ্ধে আইন ও সংবিধান লংঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ তোলেন একজন নির্বাচন কমিশনার। ওইসব অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। এর আগে রোববার রাতে বিদায়ি কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করেন।
তবে অভিযোগ ও ব্যর্থতা মানতে রাজি নন সিইসি। নির্বাচনে সহিংসতার দায়ও নিতে নারাজ তিনি। রোববার নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি নিজেকে সফল দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছি। সবগুলো নির্বাচন শেষ করে দিয়েছি। একটা নির্বাচনও বাকি রাখিনি।’ পাঁচ বছরের সফলতা তুলে ধরতে আজ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন তিনি। এদিন নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্যোগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ইসি সচিবালয় ত্যাগ করবেন তারা।
পাঁচ বছরের ব্যর্থতা-সফলতা নিয়ে কেএম নূরুল হুদা বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি পরিপূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য। কারও কথায় নয়, আইনের শাসনের মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি। একটা পদের জন্য নির্বাচন করেন সাতজন, পাশ করেন একজন। বাকি ছয়জনের সবাই তো বলেন নির্বাচন ভালো হয়নি। সুতরাং সমালোচনা হবে-এটা স্বাভাবিক। এ দেশের কালচার (সংস্কৃতি) অনুযায়ী এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর মেয়াদ আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি কাজ করছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নতুন কমিশনার গঠন না হওয়ায় কয়েকদিন কমিশনার পদ ফাঁকা থাকছে। নতুন কমিশনার যোগ দেওয়ার আগের সময়টুকু আইনত শূন্যতা হিসাবে গণ্য হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক।
সূত্রমতে, এই কমিশন পাঁচ বছরে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ছয় হাজার ৬৯০টি নির্বাচন করেছে। সম্প্রতি চার হাজার ১৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট করেছে। এ ছাড়া আইন সংস্কার, প্রবাসীদের ভোটার কার্যক্রম শুরু, স্মার্টকার্ড প্রদান, ভোটে ইভিএম প্রযুক্তির ব্যবহার, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’খচিত স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ আরপিওর বাংলা পাঠ এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন প্রণয়ন করেছে। তবে নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ না নেওয়া, বক্তৃতার নামে টাকা নেওয়া, আরপিও থেকে প্রার্থিতা বাতিলে ইসির ক্ষমতাসম্পন্ন ধারা ৯১ই বাদ দেওয়ার উদ্যোগ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পুরো মেয়াদেই বিতর্ক ও সমালোচিত ছিল।
সূত্রমতে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, সিইসি ও ইসি সচিবের কার্যক্রম নিয়েও ছিল চরম বিতর্ক। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত কমিশনের ৬৫তম সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী তার বক্তৃতায় ইসি সচিবালয়ের কাজকর্মে আইন ও সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন। ওই বছরের ৯ আগস্ট এক আনঅফিসিয়াল (ইউও) নোটে মাহবুব তালুকদার বিষয়টি কমিশন সভার এজেন্ডাভুক্ত করে বিশেষ সভা আহবানের অনুরোধ জানান। গুরুতর ওই অভিযোগের সুরাহা না করেই বিদায় নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, অসদাচরণের অভিযোগে সুপ্রিম জুডিশিয়াল গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে দেশের ৪২ নাগরিকের চিঠিও রয়েছে।
সূত্রমতে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কুমিল্লা, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে প্রশংসিত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই একাদশ সংসদ নির্বাচনের কাজের তালিকা বা রোডম্যাপ প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আইন পরিবর্তন, সীমানা পরিবর্তন ও নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয়। বিদায়ি কমিশনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। বিরোধী পক্ষ বারবার অভিযোগ করেছে, দিনের ভোট রাতে হয়েছে। ওই নির্বাচনে ভোটের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলেও অনেক অসংগতি দেখা যায়। ওই নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পর নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করে ইসি। এতে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। যা নির্বাচনি কর্মকর্তাদের কাছেও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। এরপর অন্য নির্বাচনগুলোতেও বিনা ভোটে জয়ের নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়ে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায়। সদ্যসমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ৩৭১ জন চেয়ারম্যান বিনাভোটে বিজয়ী হন। এছাড়া সহিংসতায় প্রায় দেড় শতাধিক প্রাণহানি হয়।
এসব সহিংসতার বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার সিইসি কেএম নূরুল হুদা বলেন, সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে তা নয়। মারামারি হয়েছে, কোথাও ব্যালট ছিনতাই হয়েছে। আবার ধরা পড়েছে। আবার নির্বাচনও বন্ধ হয়েছে। আবার পুনরায় নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং সবগুলো নির্বাচন পরিপূর্ণ সুষ্ঠু হয়েছে তা বলা যাবে না। কিছু নির্বাচন তো এমন হয়েছেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে। শীতের দিনে রোদের মধ্যে নারী-পুরুষ লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছে। নির্বাচনে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ছে। এর চেয়ে সফল নির্বাচন আর কী হতে পারে।
সূত্রমতে, নির্বাচনের পাশাপাশি আইন সংশোধন কার্যক্রম নিয়েও বারবার সমালোচনা শুনতে হয়েছে বর্তমান কমিশনকে। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনি আইন-বিধিমালার সংশোধনে পরামর্শকের পেছনে ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং ভোটার তালিকা আইন ও বিধিমালায় ২১ বার ক্লারিক্যাল সংশোধনী এনেছে। তবে কোনো আইন বা বিধিমালায় তেমন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। উলটো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) থেকে প্রার্থিতা বাতিলে ইসির ক্ষমতা সংক্রান্ত ধারা ৯১ইসহ বেশ কিছু মৌলিক ধারা বাতিলের চেষ্টা করে সমালোচিত হয়েছে। নির্বাচনে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে মোটা অঙ্কের ভাতা নেওয়া, বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসা, কমিশন সচিবালয়ের সঙ্গে কমিশনারদের দূরত্বসহ বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েও পুরো মেয়াদে আলোচনায় ছিল। পাঁচ বছরে মাত্র দুবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে পেরেছে। বিদায় বছরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু করতেই পারেনি।