এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট প্রাণঘাতী রোগ এইডস। বাংলাদেশে এইডস সংক্রমিত হয়েছেন ১৪ হাজার জন। এদেশে আক্রান্ত কম হলেও ঝুঁকি বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশে ভারত ও মিয়ানমার এ রোগের উচ্চঝুঁকিতে। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট শনাক্ত রোগীর বড় একটি অংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। সবকিছু বিবেচনায় এইচআইভির সংক্রমণ রুখতে দেশের বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি নাগরিকদের মধ্যেই বাড়াতে হবে সচেতনতা। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার উচ্চঝুঁকির দেশ। তাদের সঙ্গে এদেশের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের নানারকম যোগাযোগ আছে। তাই জনগোষ্ঠী সচেতন না হলে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে না।
এইডস আমাদের দেশে প্রকট নয়। তারপরও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। স্পটভিত্তিক ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে হবে। হাউজহোল্ড লেভেলে খুব কম। এটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। এইচআইভি বিষয়ে আরও নতুন তথ্য আনতে হবে। মানুষ কতটুকু সচেতন সেই তথ্য দিতে হবে
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, এইচআইভি সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ লো প্রিভিলেন্স (স্বল্প ব্যাপকতা) ও উচ্চঝুঁকির দেশ। দেশে মোট ১৪ হাজার এইচআইভি সংক্রমিত (এইডস) রোগী আছে। তবে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন কারণে। দুটি দেশের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত। দুটি দেশই উচ্চঝুঁকিতে। এদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।
‘ভারত ও মিয়ানমার থেকে লোকজন বাংলাদেশে আসে। এজন্য বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরে এইচআইভি স্ক্রিনিং টেস্ট চালু করা জরুরি। এই টেস্টে খুব বেশি খরচ হবে না, কিছু কিট দিলে ১০ মিনিটেই পরীক্ষা করা সম্ভব। জাতিসংঘের অনেক অলস টাকা পড়ে আছে। আমরা এইচআইভি স্ক্রিনিং টেস্ট করানোর জন্য এই অর্থ ব্যবহার করতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত থেকে, আক্রান্ত মা থেকে শিশুর এবং অনিরাপদ যৌন মিলনের ফলে এই রোগ ছড়ায়। এখন সমাজের পরিবর্তন হয়েছে। এইচআইভি সংক্রমণরোধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন। অবশ্য এইডসের অন্তত একটি বাহক সম্পর্কে অবগত ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। ৩৬ শতাংশ নারী সবগুলো বাহক সম্পর্কে অবগত। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ বাহক সম্পর্কে নারীদের মধ্যে সচেতনতার হার বেড়েছে ৭ শতাংশ। যদিও ৮-১০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল সরকারের।
সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত হারে প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় নারীদের মধ্যে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করে সরকারি সংস্থা বিবিএস।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রামের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৬৯ জনের এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত বছর নতুনভাবে এইচআইভি সংক্রমিত ৭২৯ জনের মধ্যে পুরুষ ৪২০ জন, নারী ২১০ ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ জন। গত এক বছরে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর ১৮৬ জন (২৬%), রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬%), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০%), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (৮%), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (২%), সমকামী ৬৭ জন (৯%), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (৭%) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (২%) রয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এসডিজি ফোকাল পয়েন্ট আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এইডস আমাদের দেশে প্রকট নয়। তারপরও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। স্পটভিত্তিক ট্রান্সমিশন বন্ধ করতে হবে। হাউজহোল্ড লেভেলে খুব কম। এটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায়। এইচআইভি বিষয়ে আরও নতুন তথ্য আনতে হবে। মানুষ কতটুকু সচেতন আছে সেই তথ্য দিতে হবে। আমরা মিক্স সার্ভের আওতায় এইচআইভির বিষয়ে আরও বেশি বেশি তথ্য সংগ্রহ করবো। সার্ভের আওতায় সচেতনতার বিষয়টি উঠে আসবে।’
বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে, দেশে ১৪ হাজারেরও বেশি এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছেন। চিকিৎসার আওতায় এসেছেন ৮৪ শতাংশ। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু হয় ২০৫ জনের। এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫৮৮ জনের।
বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথম যিনি শনাক্ত হয়েছিলেন, তিনি এখনো সুস্থভাবে বেঁচে রয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবে এইচআইভি চিকিৎসা কর্মসূচির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। সংক্রমিতদের মধ্যে রয়েছেন নারী ও পুরুষ যৌনকর্মী, সমকামী, যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি, প্রবাসী শ্রমিক, হাসপাতালে প্রসব সেবা নিতে আসা মা ও রোহিঙ্গা। আক্রান্তদের ৩৩ শতাংশ সাধারণ মানুষ।
স্ক্রিনিং বিষয়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এইচআইভি সংক্রমণ রোধে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা জনগোষ্ঠীর স্ক্রিনিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ভূইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা নিয়ে পরিকল্পনা আছে। স্ক্রিনিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নত করা হচ্ছে। এইচআইভি রোধে স্ক্রিনিংয়ের বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’