ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: আমি এসএসসি পাস করেছি ১৯৬৮ সালে। সে বছরই করটিয়ার সা’দত কলেজে ভর্তি হই। আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ভাসানীপন্থী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। ‘কিলার বক্তা’ হিসেবে আমার বেশ নাম হয়ে যায়। তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের বক্তৃতার ভালো নকল করতে পারতাম। ফলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য গ্রামেগঞ্জেও ডাক পেতাম। ১৯৬৯ সালে যখন সারা দেশ আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিলো তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করলেন। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্রের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হলো। কলেজ এলাকায় অবস্থান অনিরাপদ মনে করে আমি চট্টগ্রামে চাচার আশ্রয়ে চলে গেলাম।
চাচার পাইকারি মালের ব্যবসা। চাল, ডাল, চিনি এসব। নতুন করে সেখানকার কোনো কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করিনি। চাচার দোকানে বসি। সেখান থেকে কাছেই ছিল একটা সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। কখনো কখনো সেখানে গিয়ে সারা দিন বই পড়ি। এ রকম আলস্যে সময় কাটছিল। ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে মনে হলো, এভাবে তো চলবে না। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। শুরু করলাম টিউশনি। একজন ছাত্রী পড়াই। ৫০ টাকা বেতন। এভাবে চলল কয়েক মাস। কিন্তু স্থায়ী কিছু একটা করা দরকার। আমার চাচার কাছেও ক্রমে বোঝা হয়ে যেতে থাকলাম। চাচা নানা চাকরির প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এর মধ্যে, বিমানবাহিনীতে এয়ারম্যানের চাকরির জন্য আবেদন করে টিকে গেলাম।
যে অফিসার রিক্রুটমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তিনি ছিলেন বাঙালি। স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে গিয়ে জানা গেল, আমি বাম চোখে কম দেখি। অফিসার বললেন, তোমাকে পার করে দিচ্ছি। এখনই প্রকাশ করো না। তিন চার বছর পর প্রকাশ পেলে কোনো ক্ষতি হবে না। একটা দোটানায় পড়ে গেলাম। একদিকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। অপর দিকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছি। আমার চাচাকে এসে বললাম। তিনি বললেন, চলে যা। আর না হলে তোর জন্য আর একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। বাটার দোকানে সেলসম্যান। ১২০ টাকা বেতন। মনের দিক থেকে তাতেও সায় পাচ্ছিলাম না। চাচাকে বললাম, বাটার চাকরির চেয়ে বিমানবাহিনীর চাকরিই বোধ করি ভালো হবে। তিনি বললেন, তবে তাই কর। বিমানবাহিনীতে রিপোর্ট করার সময় ঘনিয়ে আসছিল। রিপোর্টিংয়ের দিন চাচা ৩০টি টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। আমি বেরিয়ে পড়লাম।
কিন্তু ভাবছি, আমাকে তো আরও পড়তে হবে। সেটা কিভাবে সম্ভব। কী করি, বুঝতে পারছিলাম না। সারা দিন পাহাড়তলী রেলস্টেশনের কাছে ঘোরাফেরা করি। ঢাকা যাবো নাকি যাবো বিমানবাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টারে? শেষ পর্যন্ত ঢাকা যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্ধ্যায় ৬ টাকা দিয়ে গ্রীন অ্যারো মেইল ট্রেনের টিকিট কেটে রেলে চেপে বসলাম।
ঢাকার বাংলাবাজারে থাকেন আমার আরেক আত্মীয়। খুঁজে তাকে বের করলাম। কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে এলাম, বললাম তাকে। মনে হলো না যে, খুব একটা খুশি হলেন। তা ছাড়া তার যা অবস্থা দেখলাম, তাতে আমাকে দু-চার দিন খাওয়ানোর অবস্থা তার ছিল না। থাকার জায়গা নেই। খাওয়ার পয়সার সংস্থান নেই। সে এক কঠোর জীবন সংগ্রাম। ওয়াইজঘাটের বইয়ের দোকান থেকে বই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিলে দুই এক টাকা পাওয়া যায়। সে কাজও নিয়মিত পাওয়া যায় না। তার ওপর প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। কখনো একবেলা খাই। কখনো খাই না। থাকি মানবেতর পরিবেশে। তখন টিউশনি জোগাড় করে দেয়ার দালাল ছিল। দুই টাকা দিলে তারা টিউশনি জোগাড় করে দিতেন। প্রথমে একটা টিউশনি পেলাম। এক বেলা পড়ালে এক বেলা খাওয়া। তার কিছু দিন পর পুরনো ঢাকার মোঘলটুলিতে একটা টিউশনি মিলল, এক বেলা পড়ালে দুই বেলা খাওয়া। দুই বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হলে অন্য কাজ শিখতে শুরু করলাম। ছাপাখানার কম্পোজিটরের কাজ। তখন সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা কম্পোজিটরের কাজ করতেন। সপ্তাহখানেক শেখার পর জিন্দাবাহার ফার্স্ট লেনের রকেট প্রেসে কম্পোজিটরের চাকরি নিলাম। ৭৫ টাকা বেতন। তারপর জগন্নাথ কলেজে আবার প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে গেলাম। যাই হোক, এই ছিল আমার দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর ইতিহাস।
সম্প্রতি একই ধরনের ঘটনা নিয়ে খবর হয়েছেন বগুড়ার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আলমগীর হোসেন। এমএ পাস করে তিনি চাকরি খুঁজছিলেন। মনমতো চাকরি না পাওয়ায় তিনি চাকরি খোঁজার পাশাপাশি টিউশনি করছিলেন। করোনাকালে তার টিউশনিগুলো চলে যায়। একটি মাত্র টিউশনি আছে, দেড় হাজার টাকার। পরিবারের অবস্থা করুণ।
তারা আলমগীরকে কোনো সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন না। আলমগীরের লক্ষ্য একটি সরকারি চাকরি, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের যা হয়। তাতে আমি কোনো দোষ দেখি না। কিন্তু সরকারি চাকরি তো দুষ্কর কথা। তার টিউশনি চলে যাওয়ায় দুই বেলা ভাতেরই সংস্থান নেই। ফলে যেখানে তিনি থাকেন, তার আশপাশের এলাকায় একটি ফটোকপি করা বিজ্ঞাপন সেঁটেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’
ফেসবুকের কল্যাণে তার সেই বিজ্ঞাপনটি ব্যাপক প্রচার পায় আর জাতীয় সংবাদপত্রে খবর হয়ে যায়। আলমগীর এতটা ভাবেননি। তারপর তুলকালাম কাণ্ড। ফোনে গালাগাল, ফেসবুকে কটু মন্তব্য- এসবে বিব্রত হয়ে আলমগীর তার মোবাইলই বন্ধ রাখেন। সারা দুনিয়ায় নাকি খবর হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে এমনই অভাব চলছে যে, দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে এমএ পাস একটি ছেলে পড়াতে চেয়েছে। এতে বাংলাদেশের নাক কাটা গেছে। সরকারের উচ্ছিষ্ট প্রত্যাশী ‘সাংবাদিক নামক’ ‘সাংঘাতিক’রা আলমগীরকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। ভাবখানা এমন যে, যেন বাংলাদেশে দুধের নহর বইছে, সেখানে কারো ভাতের অভাব থাকতে পারে না।
অথচ এই সাংবাদিক নামধারীরা বোধ হয় খবরও রাখেন না যে, ভারতে একটি ঝাড়–দারের চাকরি পেতে বিএ, এমএ তো বটেই, শত শত পিএইচডি ডিগ্রিধারী আবেদন করেন। তাতে তো ভারতের নাক কাটা যায় না। আলমগীরের দাবি তো অতি সামান্য। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত। আপনারা এত বড় বড় ‘দেশপ্রেমিক’ তার ভাতের ব্যবস্থা করে দিলে বুঝতাম, আপনারা কত বড় দেশপ্রেমিক।
বাংলাদেশে দুধের নহর বইছে না। তাই যদি হতো, তাহলে শত শত বাংলাদেশী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতেন না। বিদেশে একটি চাকরির জন্য ঘটিবাটি ভিটামাটি বিক্রি করতেন না।
অভাবের আরেকটি ঘটনা দিয়ে এ লেখা শেষ করব। চাঁদপুরের গৃহবধূ তামান্না আক্তার সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য পালস এইড হাসপাতালে ভর্তি হন। সিজারিয়ানের মাধ্যমে তার একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ তামান্না আক্তার। তার স্বামী আগে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, এখন বেকার। পুত্রসন্তান জন্মের পর তারা হাসপাতালের ছাড়পত্র নিতে গেলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় ২৭ হাজার টাকার একটি বিল। এ বিল পরিশোধ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এ অবস্থায় কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না তামান্না। এ অবস্থায় এক ব্যক্তি প্রস্তাব করেন যে, তার সদ্যোজাত সন্তানটি বিক্রি করে দিলে তাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে।
উপায়ান্তর না দেখে তামান্না তার স্বামীকে না জানিয়েই নিজের সন্তান বিক্রি করে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেন। সন্তান বিক্রির জন্য স্ট্যাম্পে তারা চুক্তিপত্রও করেন। এ খবর স্বামী জানতে পেরে তাকে নানাভাবে নির্যাতন করছেন। তামান্নাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘টেয়ার লাইগা পেটের সন্তানকে বিক্রি কইরা দিলাম। মা অইয়া এই কষ্ট কারে কমু। এই কষ্টের কথা কি কাউরে কওন যায়।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘কষ্টে বুকটা ফাইটা যায়।’ তবু কি আমরা বলব, বাংলাদেশে কোনো অভাব নেই?
তবে খুশির খবর হলো এই যে, বগুড়ার আলমগীরকে চাকরি দিয়েছে ‘স্বপ্ন’। আর প্রশাসনের সহায়তায় তামান্নাও ফিরে পেয়েছেন তার সন্তানকে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]