চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সপ্তম ধাপেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ের দাপট বেশি। বিরোধী জোটবিহীন নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীর ভরাডুবির পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের কৌশলী ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের একটি বড় অভিযোগ রয়েছে। তাদের মতে, মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিলেই তারা কৌশলে দল মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, যার প্রভাব পড়ে ভোটের মাঠে।
তেমনি কুমিল্লার দুই উপজেলার সপ্তম ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২৩টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র সাতটিতে জয় লাভ করেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী। আর ১৬টিতেই ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের।
জানা গেছে, দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনের মতোই এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের কেন্দ্রে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। গত সোমবার সপ্তম ধাপের ইউপি ভোটে গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নে নৌকা মার্কার প্রার্থী জিতলেও এমপির এলাকার ৮ নম্বর বনকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী মো: হুমায়ুন কবির পান মাত্র ১৮২ ভোট। সম্প্রতি উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে ওই কেন্দ্রে নৌকা মার্কা পায় মাত্র ১৬ ভোট এবং ধানের শীষ পেয়েছিল ৯৮১ ভোট।
ইউপি নির্বাচনের আগের দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ১০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী অভিযোগ করেন, স্থানীয় এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল নৌকার বিরোধিতা করছেন। নিজের পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন। ভোট শেষে নৌকার প্রার্থীদের শঙ্কাই সত্যি হয়েছে। ওই এলাকার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র চারজন বিজয়ী হয়েছেন নৌকা নিয়ে। ১০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। একটিতে প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
৭ নম্বর এলাহাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী মো: সিরাজুল ইসলাম সরকার অভিযোগ করেন, নৌকা ঠেকাতে স্থানীয় এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল মুন্সী ও তার অনুসারীরা নৌকার বিরুদ্ধে প্রচারণা ও গোপন বৈঠক করেছেন। ফলে ১৪ ইউনিয়নের ১০ ইউনিয়নে নৌকার চরম ভরাডুবি হয়েছে। ধামতী ইউনিয়নের অপর পরাজিত নৌকার প্রার্থী মো: জসীম উদ্দিনও একই অভিযোগ করেন।
অবশ্য স্থানীয় এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল মুন্সী তাদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত নিয়ে ঐক্য করে নৌকা ঠেকানোর যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। স্থানীয় নির্বাচনে এমপিদের বিধিনিষেধ থাকায় আমি নির্বাচন চলাকালে কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারব না বলে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বরাবরে ঠিঠি দিয়েছি। এমপি আরো বলেন, সংশ্লিষ্টরা প্রার্থী নির্বাচনে অযোগ্যদের মনোনয়ন দিয়েছেন, নৌকার প্রার্থীর বিজয়ে নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। তা ছাড়া বিদ্রোহী যারা পাস করেছে তাদের অধিকাংশই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদের নেতাকর্মী।
এর আগে তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দু’টিতে নৌকা মার্কার প্রার্থী জয় লাভ করে। আর ১০টিতেই পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। নৌকার প্রার্থী হেরে যাওয়ার পেছনে স্থানীয় এমপি কবিরুল হক মুক্তির কৌশলী ভূমিকা ছিল বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে।
সপ্তম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। উপজেলার ১৭ ইউপির মধ্যে তিন ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয় পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, দলীয় প্রতীকে উপযুক্ত প্রার্থী দিতে না পারা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় আওয়ামী লীগের এমন ফল বিপর্যয় হয়েছে। দলের এমন ভরাডুবির প্রসঙ্গে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, বিভিন্ন ইউনিয়নে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও একটা গাছাড়া ভাব ছিল।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীর তিন গুণের বেশি ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো: ইন্তাজ আলী। দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি প্রসঙ্গে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: কামাল আহমদ বলেন, ইউপি নির্বাচনে আঞ্চলিকতা একটি বড় বিষয়। এ ছাড়া প্রার্থী ও স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় দলীয় প্রার্থী কম ভোট পেয়েছেন বলে আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, মনে রাখতে হবে এটা আঞ্চলিক নির্বাচন। অনেক জায়গায় পছন্দের প্রার্থীরা মনোনয়ন না পেলে মন্ত্রী-এমপিরা বিরাগভাজন হয়ে থাকে। যার প্রভাব অনেকসময় ভোটে পড়ে। এটা একটি কারণ। তবে আঞ্চলিক নির্বাচনে প্রার্থীর প্রভাব যে এলাকায় বেশি থাকে ওই প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনাও বেশি। অনেক জায়গায় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, নির্বাচনে হারজিত থাকবে। তবে কেন হারছে এর জন্য নিরপেক্ষভাবে দলীয়ভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ভুলগুলো শোধরাতে পারলে আগামীতে দলীয় প্রার্থীদের জয়ের জন্য আরো ভালো করা সম্ভব।