২০১১ সালের আগে জন্মনিবন্ধন করে সনদ নিয়েছেন এমন নাগরিকদের বেশির ভাগের জন্মনিবন্ধনের তথ্য সংরক্ষিত নেই সরকারের কাছে। তাদের নিবন্ধন উধাও হয়ে গেছে। এসব ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন অনলাইন সার্ভারে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাচ্চাদের জন্মসনদ গ্রহণ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন কোটি কোটি মানুষ। এখন ভোগান্তিতে পড়া নাগরিকদের নতুন করে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। ইস্যুকৃত জন্মনিবন্ধন সার্ভারে এন্ট্রি না দেয়ায় এ ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভোগান্তির পেছনে দায় কাদের তা নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। সাধারণত জন্মনিবন্ধনের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তথা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের।
কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কাজটি সরকারের কোনো কর্মচারী সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, ২০১১ সালের আগে যারা জন্মনিবন্ধন করেছেন তাদের আবার নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। পুরনো জন্মনিবন্ধন যদি অনলাইন সার্ভারে আপলোড না হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করণীয় নেই। ইউনিয়ন পর্যায়ে উদ্যোক্তারা এই কাজ করে থাকে। তারা সরকারের বেতনভুক্ত কেউ না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যারা ম্যানুয়ালি জন্মসনদ নিয়েছেন তাদের মধ্যে যারা নিজ উদ্যোগে বা সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন অফিস থেকে সার্ভারে এন্ট্রির আবেদন করেননি। ফলে তাদের জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য সার্ভারে যায়নি। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, যারা ম্যানুয়ালি জন্মসনদ নিয়েছে তাদের তথ্য অনলাইনে আপডেট করার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় ছিল। এই কার্যক্রম নিবন্ধন অফিসগুলোরই করার কথা। ইউনিয়ন পর্যায়ে কিছু কাজ হলেও পৌর এলাকাগুলোতে এটা সীমিত ছিল। যে কারণে বহু মানুষের তথ্য এখন আর অনলাইনে নেই। এখন আবার নতুন সার্ভারে পুরনো তথ্য স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। ফলে যাদেরটা বাদ পড়েছে তাদের নতুন করে জন্মনিবন্ধন করাতে হবে। তবে এটি সংখ্যায় কত সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে। সরকার ২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন বিষয় আইন করে, যা ২০০৬ সাল থেকে কার্যকর হয় এবং মূলত তখন থেকেই জন্মনিবন্ধনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এই আইনের আওতায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-লিঙ্গ নির্বিশেষে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে সবাইকে জন্মনিবন্ধনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ ছাড়া মৃত্যুরও ৪৫ দিনের মধ্যে ওয়ারিশদের মৃত্যুসনদ সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। এরপরই ১৮টি কাজের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০১১ সালের শেষ দিক থেকে আগে নেয়া জন্মসনদগুলোর তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করা শুরু হয়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় পনের লাখ সনদের তথ্য আপলোড হয়েছে। ২০১৩ সালে সরকার আইন সংশোধন করে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়কে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব দেয়, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে।
এরমধ্যে ২০১১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের নতুন ওয়েবসাইট ও সার্ভার চালু করা হয়। যা ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময় গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুরনো নিবন্ধিতদের জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে সাড়া মেলেনি এবং নিবন্ধন কার্যালয়গুলোও নিজ থেকে আপলোড না করায় আবেদনগুলো বাতিল হয়ে যায়। সম্প্রতি করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিকল্প হিসেবে জন্মনিবন্ধনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বাচ্চাদের স্কুল ভর্তিতে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক রয়েছে। ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারির পর যাদের জন্ম তাদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে শিশুর জন্মের প্রমাণপত্র বা টিকার কার্ড লাগবে। সঙ্গে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে শহর থেকে ছুটছেন গ্রামে বা পৌরসভায়। সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছেন যে তার তথ্যও অনলাইনে এন্ট্রি হয়নি। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের আগে নিজেদের জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অনলাইনে জন্মসনদের আবেদন গ্রহণের বিধান থাকলেও বেশির ভাগ সময়ে এ সংশ্লিষ্ট সার্ভার বন্ধ থাকে। ফলে তাদের নিবন্ধন কার্যালয়গুলোতে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়া সেবা মিলছে না। বাংলাদেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. ওসমান ভূঁইয়া বলেন, জন্মনিবন্ধন উধাওয়ের বিষয়টি নিয়ে তারা খুব ঝামেলায় আছেন। এর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা কিছু বলতে পারছেন না।