মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর পিস্তলের চারটি গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তখনও তিনি জীবিত ও সজাগ ছিলেন। সে সময় তিনি মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে সিনহা একটু পানির জন্য আকুতি-মিনতি করেন। তখন উত্তেজিত লিয়াকত আলী বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য?’
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সাবেক ওসি প্রদীপ, তার সহযোগী এবং সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিয়াকত আলীর নৃশংসতার কথা এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ১৩ নম্বর পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে। এরপর রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছালে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য রাজীব গাড়িটি থামার সংকেত দিলে তাঁরা গাড়িটি থামান। তখন রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে গাড়ির বাঁ-পাশের আসনে বসা সিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। এ সময় ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা মো. রাশেদ নিজের পরিচয় দেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর রাজীব এবং অন্য দুজন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও আবদুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
মেজর সিনহা তখন গাড়িটি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। হঠাৎ মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের নাম শুনেই মো. লিয়াকত আলী চিৎকার করে গাড়িটির সামনে চলে আসেন এবং আবার তাঁদের পরিচয় জানতে চান। পুনরায় মেজর (অব.) সিনহা নিজের পরিচয় দেন। তখন লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে আবার ব্যারিকেড তুলে রাস্তা বন্ধ করে দেন। এ কাজে এসআই নন্দ দুলালও সহযোগিতা করেন। এরপর লিয়াকত আলী পিস্তল তাক করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সিনহা মো. রাশেদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং গাড়ির সব যাত্রীকে দুই হাত ওপরে তুলে নেমে আসতে বলেন। হঠাৎ তাঁর চিৎকারে রাস্তার দুপাশে চলাচল করতে থাকা লোকজনও হতচকিত হয়ে যান এবং ঘটনাস্থলে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য পথচারীরা দাঁড়িয়ে যান। এ চেকপোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার লাইট দিয়ে আলোকিত করা ছিল এবং এতে আশপাশের মসজিদ, বাজার ও রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন পরিষ্কারভাবে সব কিছু দেখতে পেতেন।
অভিযোগপত্রের ১৪ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। তখন গাড়ির দুই নম্বর আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। ড্রাইভিং সিটে বসা মেজর সিনহাও দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কাম ডাউন’, ‘কাম ডাউন’ বলেন এবং লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
লিয়াকত আলী মেজর সিনহার পরিচয় জেনে তাঁর কোনো কথা না শুনে এবং তাঁকে কোনো সময় না দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে প্রথমে দুই রাউন্ড গুলি করেন এবং কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন। এতে মেজর সিনহা রাস্তায় পড়ে যান। গুলি করার পর লিয়াকত আলী মেজর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন। তখন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত আহত সিনহা মো রাশেদকে হাতকড়া পরান। কিন্তু, এসআই মো. শাহাজাহান আলীর কাছে হাতকড়া না থাকায় লিয়াকত তাঁকে গালমন্দ করেন এবং রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। তখন কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে ইমন পাশের শামলাপুর বাজারের দোকান থেকে রশি এনে এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল রাজিবের সহযোগিতায় সিফাতকে রশি দিয়ে বাঁধেন।
ঘটনার পর লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা বলেন এবং তিনি ওসি প্রদীপকে ঘটনাটি জানান। এর কিছুক্ষণ পর রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে লিয়াকত আলী ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানান। সিনহা মো. রাশেদ তখনও জীবিত ও সজাগ ছিলেন এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে মেজর সিনহা একটু পানি খাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। এটা শুনে এবং তাকে তখনও জীবিত অবস্থায় দেখে লিয়াকত আলী আরও উত্তেজিত ওঠেন। তিনি সিনহাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য?’ এরপর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যান এবং তার বুকের বাঁ-পাশে জোরে কয়েকটি লাথি মারেন এবং পা দিয়ে বুক চেপে ধরেন। পরে ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে আরেক দফা নির্যাতন করেন। এ সময়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সিনহা মো. রাশেদ।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) দুই নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) তিন নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫ কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে সোমবার (৩১ জানুয়ারি) আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা দিন ধার্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল।
মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা—সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।