এশীয় নেতাদের রাজনৈতিক গ্রেপ্তার-কারাভোগ

Slider সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

65416_f6

বুধবার বাংলাদেশের একটি আদালত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটির রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়াজুড়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সিরিজ আইনি মামলার সর্বশেষ ঘটনা এটি। এসব মামলার কিছু বৈধ, কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গতকাল ‘লিডার্স ইন এশিয়া ফেস জেল, অ্যারেস্টস- অফেন ডিউ টু পলিটিকস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব বলেছে বার্তা সংস্থা এপি। এতে বলা হয়, মামলার শিকার রাজনীতিকদের মধ্যে আছেন থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রা। তিনি এখন নির্বাসনে। কারারুদ্ধ রয়েছেন মালয়েশিয়ার বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। এ তালিকায় চলতি সপ্তাহে যোগ হয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর রয়েছেন বাংলাদেশের ‘দুই নারী’। তাদের দুজনকেই অতীতে নানা অভিযোগে কারান্তরীণ করা হয়েছে। পরিশেষে সেসব অভিযোগ কখনই প্রমাণিত হয় নি। কখনও কখনও এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রায়ই আবার তা পরিষ্কার হয় না। প্রতিবেদনে এশিয়ার শীর্ষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তারের নানা সাম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রসঙ্গ।
এতে বলা হয়, দুটি দুর্নীতি মামলায় চারবার আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তার আইনজীবীরা বলছেন, তিনি অসুস্থ। আর তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ডাকা দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচিতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় তিনি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। ৬৯ বছরের খালেদা জিয়ার দাবি, তার প্রয়াত স্বামীর নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো রাজনৈতিক ভয়ভীতি প্রদর্শনে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার তা অস্বীকার করে। খালেদা জিয়াকে কখন বা আদৌ গ্রেপ্তার করা হবে কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হওয়া যায় নি।
এতে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রা প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, প্রায় এক দশক ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটে দ্বিধাবিভক্ত থাইল্যান্ড। ২০০৬ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হন থাকসিন। তিনি গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় থাকলেও ব্যাংককের সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আর রাজপন্থিদের সুনজরে ছিলেন না। তৎকালীন একটি দুর্নীতি মামলায় কারারুদ্ধ হওয়া এড়াতে তিনি বছরের পর বছর ধরে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে রয়েছেন। ওই মামলাটি তার বিরুদ্ধে আনিত অনেকগুলো মামলার একটি যেটাকে থাকসিন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দেখা হয়ে থাকে। তার বোন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইংলাক শিনাওয়াত্রা ২০১১ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেন। কিন্তু গত মে মাসে স্বজনপ্রীতির অভিযোগে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ইংলাককে উচ্ছেদের পর দ্রুতই আরেক সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এতে সেনাপ্রধান প্রায়ুথ চান-ওচা অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সংস্কার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রায়ুথ। কিন্তু সমালোচকদের বক্তব্য, রাজনীতিতে সিনাওয়াত্রা পরিবারের প্রভাবমুক্ত করার জন্যই এসব সংস্কার তৈরি করা হয়েছে।
মালয়েশিয়া: দেশটিতে সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে তার ৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করা শুরু করেছেন। ২০০৮ সালে এক পুরুষ সহকারীকে বলাৎকারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়। আনোয়ার নিরপরাধ বলে তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তার দাবি তিনি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিরোধীদের অসাধারণ অর্জনে নেতৃত্ব দেয়ার পর থেকে তাকে সরকারের জন্য সব থেকে জোরালো হুমকি হিসেবে দেখা হয়। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তিনি আরও অগ্রগতি করেছিলেন। এ নিয়ে দু’বারের মতো তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হলো। ১৯৯৮ সালে সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণের পর প্রথমবার কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ২০০৪ সালে শীর্ষ আদালত ওই রায় বাতিল করার পর তিনি মুক্তি পান।
চীন: দেশটির সাবেক এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঝাউ ইয়ংক্যাং’কে ডিসেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধ তদন্তের মুখোমুখি করা হয়েছে। তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চরম-ক্ষমতাধর পলিট ব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করা হয় নি। তার অতীত সহকর্মীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা তেল শিল্প থেকে শুরু করে পুলিশ ও প্রাদেশিক সরকারে কর্মরত ছিলেন। প্রসিকিউটররা ব্যাপক দুর্নীতি কর্মকাণ্ডের তদন্ত করছেন বলে এতে ইঙ্গিত মেলে। এক সময় চরম ক্ষমতাধর এক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো ঝাউকে। এখন তিনি বিচারের কাঠগড়ায়। ১৯৮১ সালের পর বিচারের আওতায় আসা তিনিই সব থেকে উচ্চপদস্থ চীনা কর্মকর্তা। আর বর্তমান শীর্ষ নেতা ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করার পর ফাঁদে পড়া সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও তিনি। সরকারি গণমাধ্যমে এটাকে পদমর্যাদা নির্বিশেষে দুর্নীতি সমূলে নির্মূল করতে কমিউনিস্ট পার্টির দৃঢ় সঙ্কল্পের উদাহরণ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অবশ্য, অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, নিজের ক্ষমতা সংহত করার জন্য ঝাউকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন শি। এমনও ইঙ্গিত রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্তরে পর্দার আড়ালে দলাদলির কারণেই পতন হয়েছে ঝাউয়ের।
তাইওয়ান: দু’বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট চেন শুই বিয়ান’কে ২০০৯ সালে ঘুষ এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে আপিলে তা কমিয়ে ২০ বছর করা হয়। স্নায়ুবিক অসুস্থতার কারণে চলাচলের ক্ষমতা হুইল চেয়ারে সীমিত হওয়ার পর ৫ই জানুয়ারি তাকে মেডিক্যাল প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। ২০০০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে চেন তাইওয়ানে ন্যাশনালিস্ট পার্টির অর্ধশতকের শাসনের অবসান ঘটান। এর পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে তাইওয়ানের ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বাধীনতা সুদৃঢ় করতে তার প্রচেষ্টার ফলে চেনের প্রতি চরম বিরূপ হন অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা ও চীনের রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। পারিবারিক স্ক্যান্ডাল আর তাকে উচ্ছেদ করতে বার বার প্রচেষ্টা থেকে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, তার বিরুদ্ধে আদালতের দণ্ড ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মালদ্বীপ: দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিরোধী নেতা মোহাম্মদ নাশিদকে  রোববার গ্রেপ্তার করা হয়। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন শীর্ষ এক বিচারককে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়ার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ করা হয়, নাশিদ ওই বিচারককে গ্রেপ্তার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাকে মুক্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ উপেক্ষা করেছিলেন। সরকারের জোর দাবি নাশিদের গ্রেপ্তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। আর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেননা, তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এদিকে নাশিদের দল বলছে, তাকে গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে রাজনীতি। ২০০৮ সালে মামুন আব্দুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন নাশিদ। ২০১২ সালে ওই বিচারককে গ্রেপ্তারের আদেশ দেয়াকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহের প্রতিবাদের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মামুন আব্দুল গাইয়ুমের সৎভাই ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের কাছে হেরে যান নাশিদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *