কাওরানবাজারে মালামাল ওঠা-নামার কাজ করেন নওগাঁর আবদুল আজিজ। অনেক পরিশ্রম হলেও তার জীবন ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের। আয়-রোজগার ছিল ভালই। কোন দিন এক হাজার, কোন দিন এক হাজার ৫০০। কিন্তু বিরোধী জোটের টানা অবরোধ-হরতালে দুর্ভোগ নেমে এসেছে তার জীবনে। দৈনিক আয় এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আবদুল আজিজ জানালেন, তার সঙ্গে কাজ করতেন আরও ১৫ জন। কাজ না থাকায় তাদের মধ্যে ১০ জন চলে গেছেন গ্রামে।
আবদুল আজিজের সঙ্গীদের মতো বহু শ্রমজীবী মানুষই এখন ঢাকা ছাড়ছেন। যারা আছেন তারাও চলছেন ধারদেনা করে। এভাবে চলতে থাকলে আর কত দিন ঢাকায় থাকতে পারবেন তা নিয়েও রয়েছেন সংশয়ে। জীবনের তাগিদে পরিবার-পরিজন ফেলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের সন্ধানে এসেছিলেন তারা। নিম্ন আয়ের এ মানুষগুলোর অনেকের ঘুমানোর জায়গাও নেই এ শহরে। ফুটপাথ-রাস্তাঘাটেই কাটে তাদের দিনরাত। হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে রোজগারের সামান্য টাকায় চালাতে হয় সংসার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলা অবরোধ-হরতালে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। এদের বেশির ভাগই ভূমিহীন। এলাকায় একখণ্ড ভিটেমাটির ওপর মাথাগুঁজে আছে তাদের পরিবার। এ অবস্থায় হাতছাড়া করতে হতে পারে সেই মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুও। কিন্তু এরপর কি? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তাদের কারও। শ্রমজীবী মানুষ ছাড়াও ঢাকা ছাড়ছেন ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীসহ সঙ্কটে কর্মহীন হয়ে পড়া নানা পেশার মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যা পলিসিতে মানুষকে শহরবিমুখ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। আর এ কারণেই এসব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে রাজধানীতে কাজের সন্ধানে আসা ভাসমান মানুষগুলো।
ময়মনসিংহের বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার ট্রাকস্ট্যান্ডে শ্রমিকের কাজ করেন। তার আয়ের ওপরই চলে ৭ সদস্যের পরিবার। স্ত্রী ও চার সন্তান থাকে এলাকায়। বড় ছেলেকে ঢাকায় এনে একটি কারখানায় কাজ শিখতে দিয়েছেন। বাকি চার সন্তানের মধ্যে একজন মাদরাসা ও তিনজন এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ভূমিহীন এ মানুষটির এলাকায় ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। মোখলেছ জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। এর আগে খরচ বাদে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকা থাকতো। আর এখন সব মিলে আয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এ টাকার মধ্য থেকে ব্যবস্থা করতে হয় খাওয়া-দাওয়ার। কোথায় থাকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকায় থাকার কোন জায়গা নেই। এখানে রাখা ট্রাকের ভেতরেই ঘুমান। তিনি বলেন, আগে নিয়মিত আয় ছিল। কিন্তু এখন সপ্তাহে তিন-চার দিন আয় করা যায়, তাও খুবই কম। দীর্ঘদিন পরিবারে টাকা পাঠাতে পারেন না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বর্তমান ধারদেনা করে চলছে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ যাবতীয় খরচ। এভাবে চললে হয়তো এলাকায় গিয়ে ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হবে। এরপর কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানি না। তিনি আরও জানান, তারা প্রায় ৩০-৪০ জন একসঙ্গে কাজ করেন। আয়-ইনকাম নেই তাই ইতিমধ্যে ২০-২৫ জন ঢাকা ছেড়ে এলাকায় চলে গেছেন। সেখানে টুকটাক দিনমজুরের কাজ করছেন। কিন্তু এলাকায় তো সাময়িক কাজ। বাকি সময়টা বেকার।
কাওরানবাজারের আবদুল আজিজ আরও জানালেন, প্রতি মাসে তার ৩২০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। আর খাওয়া তো আছেই। গ্রামে তার স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। এদের একজন অষ্টম এবং আরেকজন দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। গ্রামে শুধু থাকার জন্য ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই বলেও জানান তিনি। গত রোববার তিনি ৫ হাজার টাকা ধার করে বাড়িতে পাঠিয়েছেন। একই ধরনের কথা জানালেন রিকশাচালক উজ্জ্বল, কবির ও ট্রাকচালক রুবেল। মহাখালী এলাকায় ভাড়ার রিকশা চালান উজ্জ্বল। তিনি বলেন, ঢাকায় মানুষ তো আসছেন না। ভাড়া হবে কিভাবে? আগে যে আয় করতেন তার অর্ধেকও আয় হয় না। ভৈরবের বাসিন্দা রিকশাচালক কবির দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন একটি বস্তিতে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করে। কবির জানান, তার পরিচিত অনেক রিকশাচালক বাড়ি চলে গেছেন। কিন্তু তার এলাকায় কোন জমিজমা নেই, তাছাড়া ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ালেখা করে। তাই যত কষ্টই হোক তাকে ঢাকাতেই থাকতে হবে। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার শাহেদ আলীও কাঁচামাল ওঠা-নামার কাজ করেন। তিনি জানান, এরই মধ্যে কাজ না পাওয়ায় ৩০-৪০ জন পরিচিত শ্রমিক ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তিনি বলেন, লোক কম হলে আয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু কাজই নেই, আয় থাকবে কিভাবে? এলাকা থেকে কাঁচামাল আসছে না আগের মতো। তাই সামান্য আয়। আগে যেখানে যাবতীয় খরচ বাদে থাকতো ৫০০-৬০০ টাকা, এখন সারা রাত কাজ করে থাকে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় প্রায় ১০ আনা শ্রমিকই চলে গেছেন। এমন চিত্র ঢাকার প্রায় সব এলাকাতেই। ফুটপাথের ব্যবসাও চলছে না। অনেকে ব্যবসা গুটিয়েও নিয়েছেন। বাস টার্মিনাল এলাকার দোকানপাটগুলোতেও বেচাবিক্রি নেই।
ঢাকার মেস বাসাগুলোও অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮২টি। এর মধ্যে ৬০টি ঢাকা শহরে। সারা দেশের মোট ৭৫টি সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ২৮টি ঢাকা শহরে। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, মানের দিক থেকেও দেশের সেরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এ শহরে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় এক কোটি সাত লাখ ৭৩ হাজারের কিছু বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০ লাখ ৩০ হাজার (২৮ শতাংশ) শিক্ষার্থী ঢাকা বিভাগে। ঢাকার একটি ছাত্রী হোস্টেলের ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মাসে তাদের অধিকাংশ বাসার সিটই খালি যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী বাড়িতে গেছে তারা আর ফেরেনি।
ঢাকা শহরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০টির মতো বাসা রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। তেজতুরী বাজার এলাকায় ছেলেদের দুটি হোস্টেল নিয়ন্ত্রণ করেন তুহিন। তিনি জানান, বর্তমান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস না হওয়ায় অনেক ছাত্র বাড়ি চলে গেছেন। তারা আর ফিরেও আসছেন না। অনেকে বাসা ছেড়েও দিয়েছেন। ফলে বাসার মালিককে ভাড়া দেয়া নিয়েও বেশ সমস্যায় আছেন তিনি। কয়েকটি কোচিং সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর শিক্ষার্থীও কম ভর্তি হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জানান, ঢাকা শহরে স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাসমান- এই তিন ক্যাটিগরির প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস করছেন। এদের মধ্যে ৩৬ থেকে ৪০ লাখ মানুষ ভাসমান। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ রাজধানীতে আসছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাসমান মানুষের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের পপুলেশন পলিসিতে ভাসমান জনগোষ্ঠী নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই। এদের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও নেই। এরা ঢাকায় আছেন মূলত কর্মসংস্থানের জন্য। তাই এমন পরিস্থিতিতে তাদের কর্মহীন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তিনি আরও জানান, পপুলেশন পলিসিতে বলা আছে, মানুষকে শহরবিমুখ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যদি এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা কমতো। বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতেন না।